পৃষ্ঠাসমূহ

আজকের সত্য আগামী দিনে মিথ্যা প্রমাণিত হবে : রতনতনু ঘোষ

বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উত্তরাধুনিক ধারণাটির কোনো সচেতন প্রয়োগ অথবা ব্যবহার কী আপনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন ?
রতনতনু ঘোষ : বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অনেক ব্যাপক ও বহুমুখি। আমরা আবহমান বাংলা ও যুক্তবঙ্গ পেরিয়ে পূর্ববাংলা এবং পূর্ববাংলা পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। বিগত ৪৩ বছর ধরে বাংলাদেশের সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে চলেছে। বৃটিশ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী, ‘৪৭-এর পূর্বে ও পরে আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবণতাসমূহ বাংলাদেশের সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রিত ও বিকশিত করেছে। বাংলাভাষা বাঙালীর ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার, সংগ্রাম ও স্বপ্নকে বহন করে চলেছে। অথচ এ ভাষাকে নিয়ে বির্তক চলেছে যে, এটি হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের নয়। কবি আব্দুল হাকিম বাংলাভাষা-দ্রোহীদের বিরুদ্ধে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন : ‘যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি !’
বাংলাভাষাকে ফরাসি, ইংরেজি, সংস্কৃত ও উর্দুর আঘাত সহ্য করতে হয়েছে ক্রগামত। বাংলাভাষার সংগ্রামের ধারায় বাংলাসাহিত্য প্রস্ফুটিত। হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি ভুসুকু পাদ লিখেছিলেন : ‘আজি ভুসুকু বাঙালী ভইলে।’ বাংলাভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধারা হাজার বছর আগে বহমান ছিল বাঙালীর চেতনায়। ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কী আশা’ ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা’, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’ – এ ধরনের উক্তিতে বাঙালীর মাতৃভাষাপ্রীতি, ভাষাভিত্তিক সাহিত্যকে সুরক্ষার তীব্র আকুতি ও সংগ্রাম প্রকাশিত। হাজার বছর আগেও উত্তরাধুনিক মনোচৈতন্যের সুস্পষ্টতা লক্ষণীয়। শাসকশ্রেণীর একাধিপত্য বাংলাভাষাভাষীরা মেনে নেয়নি। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা একাধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার। বিনা প্রশ্নে ও বিনা বিতর্কে মেনে নেয়নি বাঙালী কোনো কিছুই। চাপিয়ে দেয়া উপর-কাঠামোর সিদ্ধান্তকে তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে রুখে দিয়ে আধুনিক মনের ও মননেন এবং উত্তরাধুনিক প্রবণতার পরিচয় দিয়েছে। সেই বাঙালীর বীর সন্তানেরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষা-দিবসের মর্যাদার ভূষিত করেছে। ভাষাভিত্তিক একটি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তারা। বাঙালী জনযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় গণসংগ্রামে বিজয়ী হয়েছে। এতে উত্তরাধুনিকতার দ্রোহীসত্তা মহীয়ান হয়েছে। শুধু তাই নয়। ভাষা ছাড়াও এদেশে সংস্কৃতি নিয়ে বির্তক হয়েছে। বাঙালী সংস্কৃতিকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। বাংলা হরফে উর্দু প্রচলনের জন্য ‘পাকিস্তান উন্নয়ন বোর্ড’ অর্থ বরাদ্দ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক-ছাত্রসহ বাংলাভাষাপ্রেমী, গ্রগতিশীল জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক শক্তি চক্রান্ত রুখে দিয়েছে। রবীন্দ্ররচিত জাতীয় সঙ্গীত বর্জনের কথা বলা হয়েছিল অপশক্তির প্রণোদনাকে সার্থক করার জন্য। বাঙালীকে সমৃদ্ধ উত্তরাধুনিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত করতে সচেষ্ট থেকেছিল প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসাহিত্য বর্জনের কথা বলেছিল প্রচারমাধ্যম থেকে। জাতীয় কবি নজরুলকে তারা নিন্দা ও অপপ্রচারে কোণঠাসা করেছিল। কিন্তু পারেনি। ফকির লালন সাঁই হিন্দু না মুসলিম সেই বির্তক তুলে লালনের মানবতাবাদী ধারণাকে বর্জন করতে চেয়েছিল, তাও পারেনি। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গৌরবময় উত্তরাধিকার এবং বৈশ্বিক প্রতিভূ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ-লালন-নজরুলকে শুধু উত্তরাধুনিক নয় চির আধুনিকরূপে গণ্য করতে হয়। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়ে বিশ্ববীণা ঝংকৃত। এ হলো মানব সংস্কৃতি ও বিশ্বজনীন ভাবনার সংযোগকারী। ‘বিশ্ববাঙালী হবি যদি কায়মনে বাঙালী হ’ (রবীন্দ্রনাথ), ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’ (চন্ডীদাস), ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ (নজরুল ইসলাম), ‘চিরদিন পুষিলাম এক অচীন পাখি’ (লালন)। এভাবেই নিজেদের উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালের ও সমকালের উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে। চিরায়ত বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমকাল পেরিয়ে মহাকালের উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে। এটি উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে যায়। ভাষা-আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বাংলা নববর্ষ এসব সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাদির উত্তাপ ধারণ করে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের গতি ক্রমবিকশিত হয়েছে। উত্তরাধুনিক ধারণার খোঁজ পাওয়া যায় উপনিষদীয় তথা ভারতীয় দর্শনে। ‘সর্বং সোহহম’ ধারণায় অর্থাৎ আমি সকল কিছুতে আর সকল কিছুর অস্তিত্ব আমাতে বিদ্যমান। চার্বাক দর্শনের বস্তুবাদী ধারণায় আছে উত্তরাধুনিক ধারণার বীজ। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তা লক্ষ্য করেছেন। ‘বহুমত বহুপথ’ -এর রামকৃষ্ণীয় ধারণায় আছে উত্তরাধুনিকতা। উত্তরাধুনিকতা বহু সংস্কৃতির সহাবস্থান চায় আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও নিম্নবর্গের কন্ঠস্বরকে তুলে ধরতে চায়। গণতান্ত্রিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবসমন্বয়ের মধ্যে আছে উত্তরাধুনিকতা। বাঙালীর প্রগতিচেতনা, প্রগতিসাহিত্য ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের ধারায় বেগবান হয়েছে উত্তরাধুনিকতা। সাম্প্রদায়িক ও আধিপত্যবাদী ধারণায় উত্তরাধুনিকতা থাকে না। বাঙালী সাম্প্রদায়িক সাহিত্য বর্জন করেছে। শিক্ষার সংস্কারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার মূল উৎপাটন করে উগ্রবাদী ভাবধারা পরিহার করতে চেয়েছে বাঙালী। তারা রাজনৈতিক বহু দল-মতের প্রকাশ অব্যাহত রেখে গণতান্ত্রিক ধারণার বিকাশ ঘটাতে চায়। শ্রীচৈতন্যদেবের মানবতাবাদী ভাবধারা, লালনের মানবিক ভাবান্দোলনের উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সংকর (মিশ্রিত) বাঙালী একদিন বিশ্ববিজয়ী হবে। বাঙালী মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও নদীমাতাকে গ্রহণ করে পরিবেশবাদী হয়েছে, সাহিত্যামোদী ও সংস্কৃতিবাদী হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিচয়চিহ্ন। সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলাভাষার বিশ্বায়নে বাঙালীও অগ্রসরমান। বৈশ্বিক ভাষা ইংরেজীকে মেনে নিয়েই বাঙালী বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে অগ্রসর হচ্ছে। এক্ষেত্রে সাহিত্য ও সংস্কৃতি উপজীব্য হয়ে উঠেছে। এটি বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা যেমনটি করছে তেমনটি পশ্চিমের বাংলাভাষী, লন্ডন, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাংলাভাষাভাষীরাও তা করছে। উত্তরাধুনিকতা বহুস্বর, বহু দৃষ্টিভঙ্গি ও বহুমুখী চেতনার কথা বলে। যা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে আছে।
সাহিত্যের কালক্রমিক বিচারে উত্তরাধুনিক ধারণা কতটা জরুরি ?
রতনতনু ঘোষ : সাহিত্য প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তির বহুবর্ণিল চেতনার বাহ্যিক প্রকাশ হলেও তা শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয় বরং সর্বজনের চেতনার সামগ্রী হয়ে ওঠে। নইলে তা কালোত্তীর্ণ সাহিত্য হতে পারে না। কালগতভাবে সাহিত্যকে প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক এভাবে ভাগ করা হয়। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা বিষয়টি শুধু আধুনিকোত্তর কালকেই নির্দেশ করে না। উত্তরাধুনিকতার প্রবণতা ও বিশেষত্বগুলো বিবেচ্য বিষয়। ফলে কালগতভাবে প্রাচীন সাহিত্যেও উত্তরাধুনিকতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। আমরা বাংলার নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করি উনিশ শতকের মনীষীদের ভাবধারা ও সামাজিক আন্দোলনে। আধুনিকতা ইউরোপে এসেছিল আরো আগে। শিল্পবিপ্লবের ধারায়, ফরাসি বিপ্লবের ধারায় আধুনিকতার চেতনা ক্রমশ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হলেও আমরা এখনো কালগতভাবে আধুনিকতার বাসিন্দা হয়েও অনেকেই অনাধুনিক ও প্রাচীনপন্থী। যুক্তি-তর্ক, প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গী এগুলো উত্তরাধুনিকতার কৌশল। এ কৌশলের মাধ্যমে যে দর্শন লাভ করা যায় তা কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মধ্যেও ছিল। উদার মনোভাবের পরিচয় আমরা আজো অনেকেই দিতে পারি না। প্রশ্ন, যুক্তি, তর্ক, সমন্বয়, পরিবর্তনপ্রিয়তা এখনো আধুনিক কালের বহু মানুষের মধ্যে নেই। সাহিত্যেও একই সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি আছে। ব্যক্তি হিসেবে বহু সাহিত্যিক-দার্শনিক সমকালে বসবাস করেও চিরকালীন চিন্তা করেন, স্থানীয় পর্যায়ে থেকেও বিশ্বজননী ভাবনায় নিজেকে উর্ত্তীণ করেন। এজন্যেই বলছি উত্তরাধুনিক ধারণার মর্মবস্তু বিচারে সাহিত্যকে দেখলে সবই চিরকালীন সাহিত্যরূপে টেকসই হবে না। মানে প্রাচীন কালের চর্যাপদে এবং চন্ডীদাসের সাহিত্যেও উত্তরাধুনিকতার দর্শন নিহিত। অথচ উত্তরাধুনিক কালে বসবাস করেও অনেক সাহিত্যিক আধুনিক মনোভাবের অধিকারীই হতে পারেননি। কালগতভাবে অনেকে উত্তরাধুনিক হয়েও সাহিত্য অনুশীলনের ক্ষেত্রে আছেন মধ্যযুগীয় মানসিকতায় বন্দী। আধুনিক মানস গঠনে এখনো আমরা অনেকেই সক্ষম হইনি। প্রাচীনত্বের সঙ্গে আছে অন্ধবিশ্বাস, যুক্তিহীনতা ও প্রশ্নহীনতা। আধুনিকতার মধ্যে আছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এগুলো সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। যারা একালে বসেও হাজার বছরকে দেখতে পারেন চেতনাগত দৃষ্টিতে তারাই হতে পারেন আধুনিকোত্তর অথবা চিরকালীন দৃষ্টিভঙ্গির। এ ধারায় অনুশীলন করলে উত্তরাধুনিক কালে থেকেও উত্তর-উত্তরাধুনিক কালে উপনীত হতে পারেন।
প্রাক-আধুনিকতা এসেছিল সামন্তবাদী ধারণা দূর করে। মধ্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ের আধুনিকতা এসেছিল পুঁজিবাদের বহুত্বময় বিকাশের মাধ্যমে। উত্তরাধুনিক কালের ‘পুঁজি’ ধারণাটি মানবিক পুঁজি (মানবসম্পদ), সাংস্কৃতিক পুঁজি (শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পদ), অর্থনৈতিক পুঁজি (অর্থসম্পদ) সহ বহু ধারণায় বিকশিত। সাহিত্যের সমাজতত্ব, সাহিত্যের সাংস্কৃতিক ঘনীভবন, সাহিত্যে রূপায়িত মানবসম্পর্ক প্রভূতি ধারণ করে সাহিত্য হতে পারে উত্তরাধুনিক সাহিত্য। উত্তরাধুনিককালের মর্মবস্তু ও দর্শন-ধারণ করেই সাহিত্য হতে পারে উত্তরাধুনিক সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন রায়, প্রথম চৌধুরীর চিন্তাধারায় উত্তরাধুনিকতার পরিচয় আছে।
শুধু সাহিত্যের কালবিচার দিয়েই সাহিত্য কালোত্তীর্ণ হতে পারে না। দেখতে হবে তা যুগচেতনা ধারণ করে যুগকে অতিক্রম করতে পেরেছে কিনা। দশকের মধ্যে বন্দী থেকে অনেক কবি একদশকের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যান। সাহিত্যের দশকওয়ারী বিভাগ শুধু ব্যক্তির রচনাকাল নির্দেশের জন্য প্রযোজ্য হলেও কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের সন্ধানে বিভাজন ও মানদণ্ড তেমন জরুরি নয়।
আপনি গ্রিসের সক্রেটিস, ভারতবর্ষের উপনিষদ ও চারবাক দর্শন, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদকে এমনকি চন্ডীদাস-লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-রামমোহন ও প্রথম চৌধুরীকে উত্তরাধুনিক চিন্তাধারায় চিহ্নিত করলেন। উত্তরাধুনিক ধারণার কালখন্ডকে আরো একটু স্পষ্ট করবেন কী ?
রতনতনু ঘোষ : আমি আগেই বলেছি উত্তরাধুনিকতার কালসীমায় বসে সাহিত্য রচনা করলেই তা মর্মবস্তুগত দিক থেকে উত্তরাধুনিক হিসেবে উত্তীর্ণ হবে না। প্রাচীনকালের সময়সীমাকে আমরা চিহ্নিত করি পঞ্চ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। সাহিত্যের আধুনিককালকে চিহ্নিত করি দ্বাদশ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত। অন্যদিকে উত্তরাধুনিক কালসীমা শুরু হয়েছে মূলত উনিশ শো ষাট সন থেকে। আধুনিকতার রেশ ধরেই এলো উত্তরাধুনিকতা। দাদাবাদ ও পরাবাস্তববাদ বেশ আলোচিত হলো। সাহিত্যে সংশয়, মনোবিকলন ও নৈরাজ্যবাদ প্রশ্রয় পেলো। বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ এ ধারায় সক্রিয় থেকেছেন। সকল কালেই সমকালের লোকেরা ভাবেন তারাই অগ্রসরমান ও আধুনিক। আধুনিকতার সমালোচনা করে এর ত্রুটি ও ব্যর্থতার বিপরীতে এলো উত্তরাধুনিকতা। বলাবাহুল্য উত্তরাধুনিকতা যেমন কালের সঙ্গে যুক্ত, তেমনি তা কিছু প্রবণতা ও বিশেষত্বের সঙ্গেও যুক্ত। উত্তরাধুনিক সাহিত্য, উত্তরাধুনিক রাজনীতি, উত্তরাধুনিক সমাজ, উত্তরাধুনিক মানুষ, উত্তরাধুনিক শিল্প ও সংস্কৃতি, উত্তরাধুনিক বিজ্ঞান, উত্তরাধুনিক অর্থনীতি, উত্তরাধুনিক দর্শন, উত্তরাধুনিক ইতিহাস এসব ধারণাগুলোর আলোকে বুঝা যায় সামগ্রিক উত্তরাধুনিকতাকে। কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও সামাজিক শ্রেণী সম্পর্কের স্বরূপ ও মানদণ্ডে লক্ষণীয় উত্তরাধুনিকতা। উত্তরাধুনিক মানুষ হলো ‘সাইবর্গ’ অর্থ্যাৎ অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক যন্ত্র। এ মানুষ বহুমাত্রিক, জিজ্ঞাসু এবং সাইবার পরিসরে বিশ্বসংযোগকারী। উত্তরাধুনিক রাজনীতিতে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্বের পাশাপাশি একক ব্যক্তি ও সংগঠনের গুরুত্ব কম নয়। রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠে বিশ্বমানের বহুজাতিক সংগঠন। রাষ্ট্রের সঙ্গে এর শর্তসংযুক্ত চুক্তি হয়ে ওঠে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণের আর্থ-রাজনৈতিক চালিকাশক্তি। সামন্তবাদ পেরিয়ে আধুনিকতা বিকশিত হলো পুঁজিবাদী ধারায়। পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র প্রশ্নের মুখোমুখি হলো। সমাজতন্ত্রও সর্বত্র গৃহীত হলো না, সফল হলো না। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ইতিহাস সমালোচনা করে এবং উভয়ের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠলো সংস্কারবাদী ধারণা ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’। কল্যাণ-রাষ্ট্রকে পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখার নতুন কৌশলরূপে গণ্য করা হলো। পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরাধুনিক কালে মুক্তবাজারের ধারায় এলো বিশ্বায়ন। এ ধারণাকেও ‘পুঁজিবাদের সামাজ্যবাদী রুপ’ বলে গণ্য করা হলো। এক মানববিশ্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, বার্ট্রান্ড রাসেল ও আইনষ্টাইন যে ইতিবাচক ধারণা বিস্তার করেছিলেন বিশ্বায়ন তথা গোলকায়ন কিন্তু তা নয়। বৈশ্বিক পুঁজি এখন স্থানীয় পুঁজিকে গ্রাস করতে চলেছে। ভিসামুক্ত বিশ্বচলাচল আজও গড়ে ওঠেনি। শ্রমের অবাধ চলাচল আজো গড়ে ওঠেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী জি-৮ থেকে জি-২০ রাষ্ট্রই বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে সদস্যরাষ্ট্রগুলো বিশ্বায়নের ধারণায় উজ্জীবিত হলেও বিশ্বের ষাট ভাগ মানুষ এখনো বঞ্চিত ও শোষিত। এজন্য বিশ্বায়নবাদী অর্থ-রাজনৈতিক ধারণার সমালোচনা করা হয়। উত্তরাধুনিককালে এসে ‘উত্তরাধুনিক’ ধারণার আলোকে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি বিকশিত হয়ে চলেছে। আমেরিকা-ইউরোপ ও বৃটেনের উদ্ভাবিত ধারণাজগতই আজো বিশ্বব্যাপী জনগণের শিক্ষাব্যবস্থা ও মনোচেতনাকে প্রভাবিত করে চলেছে। বুদ্ধিদীপ্ত ভাবধারা ও তার অনুশীলন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির গতিমুখ এবং সেই সঙ্গে মিডিয়ার প্রভাব বিশ্বকে ধারণাগতভাবে সমৃদ্ধ করেছে, পরিবর্তন করেছে। উত্তরাধুনিক ধারণা বহুমাত্রিক ও গভীর। এ ধারণার বিস্তার উনিশ শো ষাট সাল থেকে ইউরোপ-আমেরিকা ও ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে। উত্তরাধুনিক ধারণার বৈশ্বিক রূপ যেমন আমরা ধারণ করছি, তেমনি উত্তরাধুনিক ধারণার স্বীকরণ এবং স্বভাষা ও সংস্কৃতির মর্মমূলেও এর স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয় ব্যাপার। এভাবে বৈশ্বিক ও স্থানিক পর্যায়ের উত্তরাধুনিক ধারণা ক্রমবিকশিত। বাংলভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরাধুনিকতার প্রবাহ বিদ্যমান তা আমি উদাহরণযোগে বিশ্লেষণ করেছি।
উত্তরাধুনিক ধারণা থেকে সমাজের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে নাকি সামাজিক পরিবর্তনের আলোকে উত্তরাধুনিক ধারণার সৃস্টি হয়েছে ?
রতনতনু ঘোষ : মানুষ সমাজের কাঠামোয় থেকেই তার চিন্তার উপাদান আহরণ করে। সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক ব্যবস্থা, সামাজিক রীতি-নীতি, সামাজিক সংস্কৃতি মানুষের মনোচৈতন্যেকে প্রভাবিত করে। আবার ব্যক্তির উদ্ভাবন, সৃস্টি, রচনা, আবিষ্কার প্রভাবিত করে সমাজকে। পৃথিবীর বহু মনীষীর ও চিন্তাবিদের ধারণার আলোকে বিশ্বসমাজের রূপান্তর সাধিত হয়েছে এবং মানুষের চেতনা ক্রমাগত প্রভাবিত হয়েছে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টটল, মার্কস, এঞ্জেল্স, লেলিল, মর্গান, বটোমর, জেফারসন, নেহেরু, গান্ধী, টলস্টল, রবীন্দ্রনাথ, সার্ত্রে, এডাম স্মিথ, অগাষ্ট কোঁৎ, আইনষ্টাইন, কেইন্স, অমর্ত্য সেনসহ বহু প্রতিভাবান লোকের নাম করা যায়। উত্তরাধুনিক ধারণাজগতকে যারা ক্রমাগত সমৃদ্ধ করেছেন এমন বহু চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করা যায়। আর্নল্ড টয়েনবি পোস্টমডার্ন, পোষ্ট হিউম্যানিস্ট ও পোস্টহিস্টোয়িরক শব্দত্রয় ব্যবহার করেছেন। ডাডলি ফিস্ট ১৯৪২ সনে উত্তরাধুনিক শব্দটি ব্যবহার করেন। পাঁচ-এর দশকে চার্লস অলসন আর ছয়-এর দশকে ইরভিং হাওয়ার্ড হ্যারি, লেভিন ‘আধুনিকতার বিচ্যুতি’ বোঝাতে ব্যবহার করেন ‘উত্তরাধুনিক’ পরিভাষা। উত্তরাধুনিক দর্শনতত্ত্বে জঁ ফাসোয়া লিওতার, জ্যাক দেরিদা, এ্যালাসডায়ার আর রিচার্ড ররোটির নাম উল্লেখযোগ্য।
ইহাব হাসান সাহিত্য ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিক ধারণার প্রয়োগ করেন। উত্তরাধুনিক সাহিত্য ও সমালোচনার তাত্ত্বিক হলেন রঁলা বার্থ, জুলিয়া ক্রিসতেভা, ওল্ফ গাংইমার ও ইয়েন। চিত্রকলার ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকরা হলেন রবার্ট রশেনবার্গ, জা তিংগুলি, জোসেফ বিউই। উত্তরাধুনিক নৃত্যের ভাষ্যকার হলেন মরিস কানিংহাম, অ্যালউইন, নিকোলাইস, মেরিডিথ মংক। উত্তরাধুনিক সঙ্গীত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলেন জন কেজ, কার্ল হিজ, স্তোক হাউসেন, পিয়ের বলেজ। উত্তরাধুনিক রাজনীতির তাত্ত্বিক হলেন হার্বাট মারক্যুজ, জ বদরিলার, উরগেন হাবারমাস। উত্তরাধুনিক মনোসমীক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় জাক লাঁকা, জিলে দেদুল্যুজ, আর ডি লিয়ায়, নর্মান ও ব্রাউন। উত্তরাধুনিক বিজ্ঞানের দার্শনিক হলেন টমাস কুন ও পল ফেয়েরাবেন্ড। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ কালপর্বে সাহিত্যে, শিল্পকলায়, সঙ্গীতে, স্থাপত্যে ও দর্শনে সূচিত হয়েছিল কিছু বিশেষ পরিবর্তন, উন্নয়ন ও প্রবণতা। মৌলবাদী আদর্শের পরিবর্তে বহুরৈখিকতার বিশ্বাস আছে উত্তরাধুনিকতার। এজন্য সমাজে বহুমত, বহু সংস্কৃতি, বহুধারা, খণ্ড-ক্ষুদ্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন, চ্যালেঞ্জ, বির্তক, যুক্তি-তর্ক, পুনর্গঠন ও পুনর্সৃষ্টির পথপরিক্রমার অগ্রসর উত্তরাধুনিকতা। উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদরা বহু টেক্সট তৈরী করেছেন পুরনো টেক্সটের বিপরীতে। এসব উত্তরাধুনিক চিন্তকদের টেক্সট সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়েছে। টেক্সট থেকে তৈরী হয় নতুন টেক্সস। এতে পাঠকের পুর্নজন্ম ও লেখকের মৃত্যু হয়। বিশেষত ফুকো, দেবিদা, লাঁকার চিন্তাধারা সাহিত্য, সমাজ ও দর্শনের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। উত্তরাধুনিকতা মানবতাবাদ, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ ধারণার বিপরীতে নয়। কিন্তু এসব ধারণার বিপরীত ধারণা বা আদর্শ বা প্রতিশব্দ তৈরী হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করে না। মানুষের সাম্যে ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী উত্তরাধুনিকতা। কিন্তু কোনো আদর্শ বা মতবাদকেই নিরঙ্কুশ অথবা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করে না তা।
উত্তরাধুনিক ধারণার ভিত্তি হিসেবে ধর্মের কোনো ধারণা আপনার জানা আছে কী ?
রতনতনু ঘোষ : যেসব ধর্মে বহুত্ববাদিতার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে যুক্তি-তর্ক ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলে, উদারতা ও খণ্ড-ক্ষুদ্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়ার কথা বলে সে সব ধর্মেও উত্তরাধুনিকতার অস্তিত্ব-পরিসর লক্ষণীয়। ঈশ্বরের বহুরূপ। অর্থাৎ তিনি এক হয়েও বহুরূপে পূজ্য। একের মধ্যে বহুরূপময়তা ও আবির্ভাবের ধারণা পুরনো হলেও তা উত্তরাধুনিকতার দৃষ্টান্ত। রাশিয়ান দার্শনিক ও সাহিত্যিক মিখাইল মিখাইলোভিচ বাখতিন (১৮৯৫-১৯৭৫) ‘হেটারোগ্লোসিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এ শব্দটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন অর্থেও ব্যবহৃত। বহুস্বর, বহুঅর্থ ও বহু দৃষ্টিকোণ বুঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়। বক্তব্যের বিভিন্নতা, সমাজের বহু দৃষ্টিকোণ ও স্তরবিন্যাস আছে। আছে মানুষের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও বহুমত। রামায়ন কাহিনীর বিশ্বায়ন ঘটে গেছে বিশ্ব প্রচারমাধ্যমগুলোর মেগা সিরিয়ালে তা পরিবেশনের মাধ্যমে। তাতেও আছে উত্তরাধুনিকতার নিদর্শন। একই শব্দের বহুত্বময় ব্যবহার, ইশারা ও সংকেতময়তা আছে। তাতেও ভাষিক উত্তরাধুনিকতার দৃষ্টান্ত আছে। সামাজিক বৈপরীত্য, শ্রেণী ও আদর্শের বৈপরীত্য এবং যৌক্তিকতা লক্ষণীয় হয় সমাজে। উত্তরাধুনিক বিশ্লেষক তপোধীর ভট্টাচার্য ‘অনেকার্থদ্যোতনা’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন বহুত্বময়তা বোঝাতে। মিথাইল বাকতিন, কার্নিভাল, কার্নিভ্যালেক্স ও কারনিভ্যালাইজেশন শব্দত্রয় ব্যবহার করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণবীদ ও দার্শনিক ভর্তৃহরি ‘স্ফোটা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ হলো অসংখ্যধ্বনিতে ভেঙে পড়া। ফুটন্ত ফুলের মাধ্যমে অনেক পাপড়ি বেরিয়ে আসে, বিকশিত হয়। এক শব্দের অনেক সম্ভাবনা ও অর্থময় পরিসর লুকিয়ে থাকে। ইউরোপে ‘প্রতীকবাদের’ মতে, কবির চিন্তায় একই বস্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে ব্যবহৃত হয় এবং তাতে নানাজনের মাধ্যমে নানা অর্থ তৈরী হয়। শূন্যতাবাদ, নীতিদর্শন ও বহুজাগতিকতার মধ্যে আছে উত্তরাধুনিকতার ধারণা। সনাতন (হিন্দু) ধর্মে, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু ধারণায় রয়েছে উত্তরাধুনিক প্রত্যয়ের উৎস। বলাবাহুল্য উত্তরাধুনিকতার কোনো মতবাদ নয়। মতবাদের প্রতি আস্থাও নেই উত্তরাধুনিক আর্দশের।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে উত্তরাধুনিকতার সম্পর্ক আছে কী ?
রতনতনু ঘোষ :অবশ্যই। সাইবার সংস্কৃতি, বিশ্বায়ন ও বিশ্বময়তা, বহুমেরুবিশিষ্ট রাজনীতি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, চ্যালেঞ্জ, বিপরীত ধারণা তৈরী, ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও পরিবর্তনময়তা হলো উত্তরাধুনিকতার ভিত্তি। উত্তরাধুনিকতার ক্ষেত্রে এজন্য অনেক পুরনো ধারণাও গৃহীত হয়েছে। উদারতা, যুক্তি, সহিষ্ণুতা, নতুনত্ব, বদলে যাওয়াম অধিবাস্তবতা, দ্বিরালাপ, পুনঃপাঠ, অপরতা এসব ধারণার মমার্থ ধারণ করে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে উত্তরাধুনিককালে। বদ্ধ ধারণা, একত্বে বন্দী থাকা, অপরিবর্তনীয়তা কখনো উত্তরাধুনিকতা বিকাশের সহায়ক ধারণা নয়। বহুমাত্রিক ধারণাগত উৎকর্ষ ঘটে এসব ধারণার প্রয়োগ ও  বাস্তবায়নের মাধ্যমে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নিয়ে এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞানপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক প্রযুক্তি, ভাবগত প্রযুক্তির ধারণা। বহু চ্যানেল, বহু দৃষ্টিভঙ্গি, বহু মতের বিকাশ, বহু সংস্কৃতির অস্তিত্বময়তার স্বীকৃতি এসেছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে। বলাবাহুল্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যারা বিরোধী তারাও প্রযুক্তির সবার্ধিক ব্যবহারে অতি উৎসাহী নিজেদের বদ্ধমূল ধারণার প্রচারে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষময়তা উত্তরাধুনিক জগতকে উত্তরোত্তর উৎকর্ষমন্ডিত করবে। পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন ইতিহাস, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন মতবাদ প্রচারের তা সহায়ক। এভাবে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে বিশ্ব। যারা পরিবর্তনবিমুখ তাদের সঙ্গে পরিবর্তনবাদীদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। বহুত্বময়তার জগতে একত্ববাদী ধারণাগুলো চ্যালেঞ্জ ও সংঘাতের মুখোমুখি হবে নিঃসন্দেহে। প্রযুক্তির উৎকর্ষমন্ডিত পরিস্থিতিতে আমরা তা লক্ষ্য করি।
উত্তরাধুনিক আদর্শ ও ধারণার সঙ্গে মার্কসবাদ, আধুনিকতা ও কমিউনিজমের সংঘাতটি কী রূপ ?
রতনতনু ঘোষ : উত্তরাধুনিক আদর্শ ও ধারণার সঙ্গে মার্কসবাদ, আধুনিকতা ও কমিউনিজমের পার্থক্য আছে। উত্তরাধুনিকতা একটি আত্মঘাতী টেক্সট। মার্কসবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ। উত্তরাধুনিকতা মতবাদ নয় বরং তা মতবাদের বিপক্ষে। মতবাদের আধিপত্য উত্তরাধুনিকতা মানে না। কিন্তু মার্কসবাদের মধ্যে যে শ্রেণীহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমের চিন্তা তা উত্তরাধুনিকতা সমর্থন করে। শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং শ্রেণী বৈষম্যের অবসানে যে জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রবাহ ও প্রপঞ্চ আছে উত্তরাধুনিকতা তাকেও সমর্থন করে। তবে সকল টেক্সটের বিপরীত টেক্সট তৈরীর পক্ষপাতী উত্তরাধুনিকতা। কমিউনিজম বা সাম্যবাদ একটি মতাদর্শ। এটি একটি মহা আখ্যান ও বাচন। এ অভিসন্দর্ভটি উত্তরাধুনিকতা গ্রহণ করে জ্ঞান ও মর্মার্থের আলোকে, মতবাদ হিসেবে নয়। অর্থাৎ ‘সাম্যবাদ’ মতবাদটির পরেও আরো মতবাদ বেরিয়ে আসবে এমন আকাক্সক্ষা করে উত্তরাধুনিকতা। আধুনিকতার বিরুদ্ধে নতুন ধারণা গঠন করেই জন্ম হয়েছে উত্তরাধুনিকতার। উত্তরাধুনিকতা আধুনিকবাদের অনেক ধারণাকে অবলম্বন করেই ক্রমবিকশিত অর্থাৎ জ্ঞানের ক্রমপরম্পরায়, সৃষ্টিশীলতায়, মতবাদের অব্যাহত গতিতে ও নতুনত্বে উত্তরাধুনিকতার সমর্থন আছে। চূড়ান্ত মতবাদে, একরৈখিকতায়, অপরিবর্তনীয় কোনো কিছুতেই উত্তরাধুনিকতার আস্থা নেই বলে উত্তরাধুনিকতার সঙ্গে যে-কোনো অনড় মতবাদ, অপরিবর্তনীয় অভিসন্দর্ভ ও মহাবাচনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
উত্তরাধুনিক রাজনীতির ধারায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র কী কাক্সিক্ষতভাবে বিকশিত হতে পারবে?
রতনতনু ঘোষ : উত্তরাধুনিক রাজনীতির মধ্যে আছে প্রযুক্তি ও মিডিয়া নির্ভরতা। বহুভাষ্য, সংগঠন ও বহু কন্ঠস্বর, খণ্ড-ক্ষুদ্র-আবেদন ও দাবির যৌক্তিকতার সংস্কৃতি। উত্তরাধুনিক রাজনীতিতে ক্ষুদ্র দল, একক ব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নবর্গীয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীয়ও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে উপেক্ষিত এবং ইতিহাস সৃষ্টির নেপথ্যে যারা কর্মরত তারাও গুরুত্বপূর্ণ। রাজার ইতিহাস নয়, জনগণের ইতিহাসই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। যেহেতু উত্তরাধুনিক রাজনীতিতে ভিন্ন মত ও আদর্শের স্বীকৃতি আছে সেহেতু সৃজনশীল ও উদার গণতন্ত্র এক্ষেত্রে সমর্থনীয়। গণতন্ত্র প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে টিকে আছে সৃজনশীলতার মাধ্যমে। এর অন্তনিহিত ব্যাপার হলো ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা। এজন্য উত্তরাধুনিকতা এর বিরুদ্ধে নয়। গণতন্ত্র টিকবে বহুমত ও বহুপথের নিয়ামক হিসেবে। গণতন্ত্রের সৃজনশীলতা ও গতিময়তাই এর টিকে থাকার শক্তি। অন্যদিকে উত্তরাধুনিকতা জাতীয়তা, জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না। উত্তরাধুনিকতা বিশ্বাস করে কেন্দ্রে আর প্রান্তে। একদিকে স্থানিক আর অন্যদিকে বৈশ্বিক এ হলো বাস্তবতা। এতদিন ধরে আমরা যে জাতি, আন্তর্জাতিকতা বলে আসছি তা রক্ষায় সংগত নয় উত্তরাধুনিকতা। বহুমাত্রিক সংগঠন এখন রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে বহু বিষয়ে আর্থ-রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এজন্য রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
উত্তরাধুনিকতা একটি বহুত্ববাদী দর্শন এবং এটি অতীত ও ভবিষ্যতে বিশ্বাস করে না। আপনি এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করেন কী ?
রতনতনু ঘোষ : উত্তরাধুনিক ধারণার অনেক বিষয় আছে যেগুলো অতীতের দর্শন থেকে আগত। যেমন বহুদৃষ্টিকোণ, বহুত্বময়তা, বহুরৈখিকতা ও বিদিশাময়তা। এসব শব্দবন্ধ নতুন নয়। উত্তরাধুনিকতা বর্তমানের উত্তাপ ধারণ করে অতীতের অনেক প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও মহাবাচন নাকচ করে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে। যেহেতু এটি কোনো মতবাদ নয় সেজন্য এর সবদিক খোলা। এর কাজ হলো ক্রমাগত বির্তক, চ্যালেঞ্জ, যুক্তি-তর্ক করে সত্যে উপনীত হওয়া এবং নতুন কিছু গ্রহণ করা। সত্যের সুনির্দিষ্ট অবয়ব ও স্বরূপ নেই। সত্য সর্বরূপে এবং সর্বত্র বিরাজমান। এজন্য সত্য সন্ধানে উত্তরাধুনিকতা সব কিছুকে খন্ড-ক্ষুদ্র করে বিশ্লেষণ করে, গভীর ও উদারভাবে ক্রমাগত গ্রহণ করে। আজকের সত্য আগামীর দিনে মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। অতীতের সত্য অবলম্বন করে সত্যের নতুন প্রেক্ষাপটে পৌঁছতে হবে। মানুষ বহুমাত্রিক এবং অনির্ণয় সত্তার অধিকারী। সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো মহাবাচন ও বদ্ধমূল ধারণার প্রতি আস্থা না থাকায় উত্তরাধুনিকতাকে বলা হয় বৈচিত্র্যময়।
উত্তরাধুনিকতা কী সামাজ্যবাদীদের নতুন কোনো কৌশল যা বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তার অথবা একমেরু বিশ্বায়নের সহায়ক ?
রতনতনু ঘোষ : উত্তরাধুনিকতা সামাজ্যবাদীদের সহায়ক ধারণা এমন অভিযোগ মার্কসবাদীরাও করেন। যেমন মার্কসবাদী পণ্ডিত টেরি ইগলটন উত্তরাধুনিকতাকে নৈরাজ্যবাদী, মার্কসবাদ বিরোধী, অগোছালো ধারণা এবং সামাজ্যবাদের সহায়ক ধারণারূপে চিহ্নিত করেছেন। বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের চুড়ান্ত রূপ। লেলিনের কথায় :‘সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ।’ বাস্তবে উত্তরাধুনিকতা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ সব কিছুরই সমালোচনা করে। সমালোচনা অথবা প্রশ্নের উর্ধ্বে কোনো কিছুকে তা ভাবতে পারে না। সবকিছুই পরিবর্তনের মাধ্যমে, সংস্কারের ধারায় টিকে থাকতে পারে। যেমন পুঁজিবাদ আদিম অবস্থা থেকে আধুনিক ও উদার রূপ লাভ করেছে। স্থানীয় পুঁজি জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ বা আধিপত্যবাদ এক সময়ে ভূখন্ড দখল করে উপনিবেশ তৈরী করে। উত্তরাধুনিক কালে নয়া উপনিবেশবাদী ধারণা বিকশিত হয়েছে। যাকে বলা হয় দূর থেকে রাষ্ট্রের অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল। উপনিবেশোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে উত্তরাধুনিকতা ভাবে। পিছিয়ে পড়া দেশুগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে উত্তরাধুনিকতা আগ্রহী। এমনকি পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে বুঝাতেও ‘উপনিবেশোত্তর’ রাষ্ট্রের ধারণা ব্যবহৃত হয়েছে। পুঁজিবাদ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুক্তবাজার, কল্যাণরাষ্ট্র, বিশ্বায়নের মাধ্যমে ক্রমরূপান্তরিত হয়ে চলেছে। হতে পারে সেদিক থেকে পুঁজিবাদীদের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে উত্তরাধুনিকতার। সাংস্কৃতিক পুঁজি, মানবিক পুঁজি, আর্থিক পুঁজি এভাবে রূপান্তরিত হয়েছে পুঁজি। এমনকি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও সামজতন্ত্রের সহাবস্থান আছে। সমাজতন্ত্রের ভালো দিকগুলো উত্তরাধুনিকতাও সমর্থন করে। উত্তরাধুনিকতা যেহেতু কোনো মতবাদে বিশ্বাসী নয় সেহেতু তা সাম্রাজ্যবাদে ও আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী নয়। একমুখী বিশ্ব হয়েছিল দ্বিমেরু বিশিষ্ট। এখন হতে যাচ্ছে তা বহুমেরু বিশিষ্ট। জি-৮ থেকে জি-২০ রাষ্ট্র হয়েছে বিশ্বনিয়ন্ত্রক শক্তি। সুতরাং বহুমেরুবিশিষ্ট পৃথিবী হতে পারে উত্তরাধুনিক ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাস্তবে বহুমেরুর পর কী হয়, উত্তরাধুনিকতার পর কী আসে তা নিয়েও সম্ভাবনার অপেক্ষায় উত্তরাধুনিকতা।
উত্তরাধুনিকতা কি সীমান্তহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠা আর শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে পারবে ?
রতনতনু ঘোষ : উত্তরাধুনিক রাজনীতি নিয়ে ভেবেছেন এবং লিখেছেন হারবার্ট মারক্যুজ, জঁ বদরিলার ও য়ুরগেন হাবারমাস। উত্তরাধুনিকতার ‘হেজিমনি’ বা ধারণাগুচ্ছে রয়েছে বৈচিত্র্য ও বিস্তারের প্রকৃতি। কোনো আধিপত্যশীল রাজনৈতিক ধারণায় তা বিশ্বাস করে না। সীমান্তহীন বিশ্ব আদর্শগত ধারণা হিসেবে উত্তরাধুনিকতার সহায়ক। কিন্তু শ্রেণীবৈষম্য সীমান্তহীন বিশ্বে কতোটা থাকবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শ্রমের অবাধ চলাচল ও ভিসামুক্ত বিশ্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হলে বৈশ্বিক সমস্যাগুলো জাতিসংঘের আওতায় অথবা বিশ্বরাষ্ট্রভিত্তিক ধারণার আলোকে মুক্ত হবে। বৈশ্বিক আদালতেই বিচার হবে অপরাধীদের। মানুষ হবে বিশ্ব নাগরিক। কিন্তু উত্তরাধুনিক রাজনীতি অনুসারে শ্রেণীবৈষম্য থাকবে না, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকবে না, সখ্য থাকবে, অভাব থাকবে না। সেহেতু আদালত, বিচার, আইনও থাকবে না। এধরনের ইউটোপীয় ধারণা সাম্যবাদী তথা সমাজবাদী চিন্তকরাও করেছেন। একটি সাম্যভিত্তিক বিশ্বসমাজ গঠিত হলে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ধারণার অবসান ঘটবে। উত্তরাধুনিকতা যেহেতু ভবিষ্যতের প্রতিও বদ্ধমূল ধারণায় বিশ্বাসী নয়, সেহেতু তখনো নতুন ধারণার আলোকে আরো অগ্রসর ও গ্রহণযোগ্য, পরিশ্রুত ও অপেক্ষাকৃত কম ক্রুটিপূর্ণ ধারণা গড়ে উঠবে। তত্ত্বের রাজনীতি উত্তরাধুনিকতায় বিতর্কিত। রাজনীতির তত্ত্ব বিনির্মাণে তা সচেষ্ট নয়। সুতরাং অব্যাহত বর্তমান নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে সর্তকভাবে অগ্রসর হওয়াই কাম্য।
এ বিষয়ে আরো জানার ছিল। কিন্তু সব প্রশ্ন করা গেল না। তবু আপনি যা বললেন আশা করি তা থেকে আমরা গ্রহণযোগ্য অনেক কিছু পাব।
রতনতনু ঘোষ : প্রশ্নের শেষ নেই। শেষের পরেও শেষ থাকে। উত্তরাধুনিকতার পরেও উত্তর-উত্তরাধুনিকতা আসবে, চির আধুনিকতা আসবে। উত্তরাধুনিকতা সমাপ্তিহীনতায় বিশ্বাস করে।