পৃষ্ঠাসমূহ

“উপলব্ধির ঘূর্ণিময় প্রবাহে, রচনার উৎকর্ষ ও সাহিত্যকৃতির মাধ্যমে লেখকসত্তা টেকসই করতে চাই” -রতনতনু ঘোষ

“উপলব্ধির ঘূর্ণিময় প্রবাহে, রচনার উৎকর্ষ ও সাহিত্যকৃতির মাধ্যমে লেখকসত্তা টেকসই করতে চাই”
-রতনতনু ঘোষ
/
রতনতনু ঘোষ সমাজপ্রগতির পিপাসু লেখক এবং মনুষ্যত্ব বিকাশের সপক্ষে চালিত শব্দনির্মাতা। ৩০ বছর ধরে এ সাধক লেখক লিখছেন প্রবন্ধ ও কবিতা। তার সমাজভাবনা ও সাহিত্যকৃতির প্রতিফলন ঘটেছে প্রকাশিত ৭২টি বইয়ে। তার মুখোমুখি হয়েছেন সাব্বির আলম চৌধুরী। 

/
প্রশ্ন: আপনি ত্রিশ বছর ধরে ক্রমাগত লিখে চলেছেন প্রবন্ধ, কবিতা, সমালোচনা, গবেষণা ও সমাজবিষয়ক নানা রচনা। আপনি কি মনে করেন লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন?
উত্তর: আমার লেখা মূলত উপলব্ধির নির্যাস। স্বকীয় চিন্তা বিভিন্ন ধারায় বেগবান হয়ে তৈরি হয় আমার লেখা। ভাব, কল্পনা, উপলব্ধি ও আকাক্সক্ষা নিয়ে গঠিত হয় কবিতার শরীর। শব্দময় চিত্ররূপে নিজের ভেতর সুবিন্যস্ত করি কবিতায়। আমি সমকালে বাস করেও মহাকালের অধিবাসী। প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে বাস্তব বোধ, যুক্তি ও তথ্যনির্ভরতা, বিষয়ের গুরুত্ব অনুভব করি। চিন্তার কারুকাজ আর বক্তব্যের নিজস্বতা ফুটে ওঠে আমার প্রবন্ধে। প্রবন্ধ ও কবিতায় আমার অন্তর্গত বিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় ঘটেছে সামান্য হলেও। একাডেমিক স্বীকৃতি কিংবা বড় ধরনের পুরস্কার জোটেনি। মানুষের স্বরূপ প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনার জন্য পেয়েছি বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার- ১৯৯৬ সালে। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর হতে প্রবন্ধের জন্য জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছি- ১৯৮৬ সালে। এ ছাড়া সংস্কৃতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুরস্কার সহ বাংলাদেশ সাহিত্য সংসদ কর্তৃক দ্বীপজ সাহিত্য পুরস্কার -২০১৬ পেয়েছি। শুধু পুরস্কার অর্জন কে প্রতিষ্ঠার মানদ- মনে করি না। রচনার উৎকর্ষ ও সাহিত্যকৃতির মাধ্যমে লেখকসত্তা টেকসই করতে চাই।
/
প্রশ্ন: এ পর্যন্ত আপনার ৭২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির মাধ্যমে আপনার অর্জন কি?
উত্তর: লেখালেখির পরিক্রমায় আমার হাজার খানেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীসমূহে। এ পর্যন্ত আমার ৭২টি বই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। তাতে আমার ভেতরের উপলব্ধি সঞ্চিত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে আমার ভাষ্য ও চিন্তাধারা। এসব লেখালেখি নিজের হলেও আগ্রহী পাঠকদের বিবেচনার জন্যই উৎসর্গিত। অনেকে লেখালেখির মাধ্যমে সামাজিক অর্জন ও অবস্থান তৈরি করে। আমি সেটি পেরেছি কি না জানি না। আমার লিখনপ্রয়াস অন্তর্গত সত্তার সম্প্রসার মাত্র। আমার লেখক সত্তা স্পর্শ করতে চেয়েছে পাঠক চেতনাকে। আমার সমাজচিন্তা সমাজ পরিবর্তন ও রূপান্তরের আদর্শিক হাতিয়ার। গণচেতনা পুনর্গঠনে এবং সমাজপ্রগতির সহায়ক হলে আমার লেখালেখি সার্থক হবে।
/
প্রশ্ন: আপনার উপর মূল্যায়নধর্মী কোন লেখা বিশেষ কোন ব্যক্তিত্ব কি লিখেছেন?
উত্তর: আমার রচনার উপর মূল্যায়নধর্মী বিশেষ লেখা লিখেছেন অনেকে। এ পর্যন্ত আমার রচিত বইগুলো নিয়ে একশ একষট্টি টি আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। খ্যাতিমান সাহিত্য ব্যক্তিত্ব আহমদ শরীফ, কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, আবুল হাসনাত, আবুল কাসেম ফজলুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ সহ অনেকে লিখেছেন। তাদের স্বহস্ত লিখিত মূল্যায়ন রয়েছে। এসব কৃতি চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকের মূল্যায়নে আমি অনুপ্রাণিত ও কৃতজ্ঞ।
/
প্রশ্ন: আপনার রচনার মাধ্যমে মানবিক-সামাজিক প্রভাব বিস্তার হয়েছে কি?
উত্তর: আমার রচনার মাধ্যমে মানবিক-সামাজিক প্রভাব বিস্তার কতোটুকু হয়েছে তা আমি মূল্যায়ন করতে পারব না। আমি লিখেছি মূলত মানবিক বোধের প্রসার আর সামাজিক বিকাশের প্রণোদনার জন্য। এ কাজটি কতোটুকু সম্ভবপর হয়েছে তা মূল্যায়ন করবেন সমাজপ্রগতির স্বপক্ষে কর্মরত ব্যক্তিগণ। সমাজবাস্তবতা ও সমকালীন এষণা আমার লেখার বিষয়বস্তু। কাক্সিক্ষত সমাজ ও মানবিক সত্তার বিণির্মাণে আমার লেখালেখি প্রয়োগধর্মী হতে পারে।
/
প্রশ্ন: মানুষের জীবন এগিয়েছে, সমাজ এগিয়েছে। তারপরও মনে হয় মনুষ্যত্ব এগোয়নি। এর কারণ কি?
উত্তর: কালপ্রবাহে মানুষের জীবন এগিয়েছে, সমাজ ও সভ্যতা এগিয়েছে। তারপরও মনে হয় মনুষ্যত্ব এগোয়নি, সভ্যতা সংকটগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ আপন প্রয়োজনে গড়েছে সমাজ ও সভ্যতা। আবার সমাজ ও সভ্যতাকে নেতিবাচক দিকে অগ্রসর করেছে মানুষ। ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী মানুষেরা আধিপত্য করছেন অনগ্রসর ও দরিদ্র মানুষের উপর। বঞ্চনা-বৈষম্য, অসমতা, বিরোধ ও দূরত্ব সৃষ্টি করে আধিপত্যবাদী মানুষেরা অধীন মানুষদের ব্যবহার করছে, শোষণ করছে, অন্যায় স্বার্থ হাসিল করছে। ফলে মানবসভ্যতা গ্লনিময় ও সংকটপূর্ণ হয়েছে। সামাজিক হানাহানি, সন্ত্রাস ও হত্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের অসন্তোষ ও বৈষম্য থেকে। সুযোগের অসমতা ও সামাজিক অব্যবস্থাপনা সমাজকে রুগ্ন করছে। সমাজের সর্বত্র সমাজপ্রগতি একই ধারায় বেগবান হয় না। এ কারণে মানুষের মনুষ্যত্ব¡ এগোয়না সমমাত্রায়।
/
প্রশ্ন: আপনার লেখালেখিতে রয়েছে বিষয়ের বৈচিত্র্য। উপলব্ধির বহুস্বর আপনি বিনির্মাণ করতে পেরেছেন?
উত্তর: আমার লেখালেখির বিষয় বিচিত্র। উপলব্ধির বৈচিত্র্যময় প্রকাশ আমার লেখালেখিতে বহুস্বর আনয়ন করে। আমি বিনির্মাণ করতে চেয়েছি চিন্তার বিভিন্নতা, সংস্কৃতির বহুত্বময়তা। বহুর সমবায়ে ঐক্যের ধারণা প্রকাশ করতে চেয়েছি। এ জন্য আমার গ্রন্থগুলো বিষয়ের বৈচিত্রে পরিপূর্ণ। প্রবন্ধ ও কবিতার মাধ্যমে উপলব্ধির বৈচিত্র্য প্রকাশ করতে চেয়েছি।
প্রশ্ন: সাহিত্য ক্ষেত্রে আপনার আত্মমূল্যায়ন কিরূপ?
উত্তর: আমি লিখে চলেছি আত্মভাবের বেগে মগ্ন হয়ে। উপলব্ধির ঘূর্ণিময় প্রবাহে, রচনার উৎকর্ষ ও সাহিত্যকৃতির মাধ্যমে লেখকসত্তা টেকসই করতে চাই। শব্দসজ্জিত চিন্তাধারায় বিকশিত আমার সত্তা। আত্মভাষ্য খননের প্রবণতা প্রগতিমুখি হলেই আত্মরূপ দেখতে পাই রচনায়।
/
প্রশ্ন: আপনার লেখালেখিতে স্বদেশ, সমকাল ও সামাজিক মানুষ বিষয় হয়েছে। এর বিশেষত্ব কি?
উত্তর: আমার রচিত বইগুলোতে রয়েছে স্বদেশ, সমকাল ও সামাজিক মানুষের আকাক্সক্ষা ও উপলব্ধি। সুবিন্যস্ত আকাক্সক্ষা ও উপলব্ধি জারিত করা আমার লেখার বিশেষত্ব। যা দেখি, যা ভাবি, যা চিন্তা করি তা সমাজপ্রগতির প্রণোদনার উপযুক্ত হলে বিশেষত্ব অর্জন করে অনিবার্যভাবে।