পৃষ্ঠাসমূহ

'উন্নয়নকর্মী ও জনসমাজ গঠনকারী শক্তি ও আজ জনগণের রক্তস্রোত অপেক্ষা ক্ষতিমুক্ত বিপ্লবাত্মক চিন্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন'


বিশ্বায়ন নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। পাঠ্য তালিকায়ও বিশ্বায়ন অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। বিশ্বায়ন কবলিত বিশ্ব আজ বিশ্বায়ন তত্ত্বে উত্তপ্ত। বিশ্বায়নের ভাল-মন্দ নিয়ে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিকরা যেমন বলছেন তেমনি বুদ্ধিজীবিগণও এ বিষয়ে লিখছেন বেশ। সম্প্রতি বিশ্বায়নের বিষয়ে কথা বলেছেন ‘বিশ্বায়নের রাজনীতি’ গ্রন্থের রচয়িতা ও প্রাবন্ধিক রতনতনু ঘোষ। তার সাক্ষাৎকার লিখেছেন কবি ও সাংবাদিক রোখসানা আফরিন।
রোখসানা আফরিন : বিশ্বায়নের রাজনীতি বলতে আপনি মূলত কি মনে করেন ?
রতনতনু ঘোষ: বিশ্বায়ন বলতে আমি বুুঝি বিশ্ববাজার দখলের সামাজ্যবাদী রাজনীতি। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ নতুন মুখোশ নিয়ে ভদ্র বেশ ধারণ করে বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লিপনা করছে। পৃথিবীর রাজধানী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানী, বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ, এডিবি ও জি-এইট সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিয়ে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির নিরাজনীতি চালু করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রভূ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে আফগানিস্তান ও ইরাকের রাজনৈতিক দখলদারিত্ব গ্রহণ করে। বিশ্বায়নের রাজনীতি মূলত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মাধ্যমে রাজনীতির আমেরিকায়ন। এজন্য বিশ্বায়নের রাজনীতি মূলত বিশ্ব রাজনীতির আমেরিকায়ন।


রোখসানা আফরিন : মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্র বিশ্ব ব্যবস্থায় জন্য আর্শিবাদ কি ?
রতনতনু ঘোষ: মূলত গণতন্ত্রের পথ ধরে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা ঘটেছে মার্কিন সংস্কার নীতি অবলম্বন করে। দেশে দেশে আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কারের নামে মার্কিন নীতিমালা ও বিশ্বপরিকল্পনায় বাস্তবায়ন করেছে গ্যাট, ডাংফেন, ওয়াটো, বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ ও এডিবি। বিশ্বব্যাপী রাজনীতির সন্ত্রাসায়ন ঘটিয়ে ডলারের নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক একক বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে মুক্তবাজারে বন্দী করাই মুক্তবাজারের চূড়ান্ত লক্ষ্য। মুক্তবাজারের বহুল কথিত সুবিধাগুলো উন্নত রাষ্ট্র ভোগ করেছে। আর তাদের অধীনতায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর বিপন্ন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
রোখসানা আফরিন : সুশাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন ?
রতনতনু ঘোষ: সিভিল সমাজ বলতে অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবি, জনসমাজের মুক্ত প্রতিনিধি ও বিবেকবান গণকন্ঠস্বরকে বোঝায়। আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে মুক্ত সুশীল সমাজ বিদ্রোহী ভূমিকা পালন করেছে দু:শাসকদের বিরুদ্ধে। এমনকি স্বাধীনতার পরও নব্বই এর গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জল ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু নব্বই এরপর থেকে এদেশের সুশীল সমাজ রূপে পরিচিত মুখগুলো দলীয় ক্যাডার বুদ্ধিজীবি হিসাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে। মার্কিন সামাজ্যবাদ ও ভারতীয় তাবেদার হিসাবে তারা তোতাপাখির ভূমিকা পালন করছেন ---- হিসাবে। স্বদেশপ্রেম ও গণপ্রেম এবং মানবাধিকার রক্ষায় তাদের ভূমিকা কার্যকর হিসাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এনজিওর তালিকাভূক্ত সুবিধাবাদী হিসাবে। অনেকেই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনীত দাস হিসাবে যেন তাদের চাকুরী করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। বলা যায় গ্রীক সমাজ অথবা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতো বিপ্লব সৃষ্টিকারী সুশীল সমাজে বাংলাদেশে বড়ই অভাব। আহাম্মদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ এর মতো নিলোর্ভ মুক্তবুদ্ধিজীবি ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে।
রোখসানা আফরিন : বিশ্বায়ন ব্যবস্থা কি সাম্প্রতিক কিছু ?
রতনতনু ঘোষ: বিশ্বায়ন ব্যবস্থা সাম্প্রতিক কালের আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার নতুন বিশ্ব পরিকল্পনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই বিশ্বায়ন ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক বিশ্ব রাষ্ট্রের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। একক বিশ্বের প্রভু হিসেবে বিশ্ব পুঁজির কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ভাগ গ্রহণের জন্য এ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের স্থানান্তর পণ্যের বিনিময়ে ছিলো এবং আছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে আজ সম্মিলিত সহযোগিতার ভিত্তিতে এ গণ স্থানান্তর ও পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা বিদ্যমান। ১৯৬০ সন থেকে বিশ্বায়ন প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির চেহারায়। ৮০ সনের দিকে উদার বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংস্কার কাঠামো বিন্যাসের মাধ্যমে দেশে দেশে বিশ্বায়ন প্রত্যয়টি বিস্তার লাভ করে। সাম্প্রতিক বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় বিশ্ববাজার দখলের আধিপত্যবাদী তৎপরতা আছে। অন্য দিকে প্রচলিত বিশ্বায়ন ধারনায় বিশ্বব্যাপী মানুষ ও পণ্যের স্থানান্তর এর মাধ্যমে সম্মিলিত সহঅবস্থানের পবিত্র ধারণা নিহিত। সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক নৃশংস তৎপরতা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে হুমকিস্বরূপ। কর্পোরেট এনজিও ও সামাজ্যবাদী পুঁজিবাদের সহায়ক হয়ে বিশ্বব্যাংক, আই.এম.আই ও ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার তৎপরতা চালাচ্ছে।
রোখসানা আফরিন : বিশ্বায়ন ব্যবস্থা কি রাষ্ট্রসমূহের জন্য অনিবার্য?
রতনতনু ঘোষ: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধীনে বিশ্বায়ন ব্যবস্থা সচল থাকলে সদস্য রাষ্ট্রের অন্তর্গত জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব ও বিকাশ সম্ভবপর হতো। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জি-৮ দেশগুলোর কর্তৃত্বপরায়ন বিশ্বায়নের কবলে পড়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো জিম্মি হয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দারিদ্র-বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচী নিয়ে বিশ্বায়নের প্রভুরা অনুপ্রবেশ করেছে পৃথিবীর দেশে দেশে। দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ ও ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারের প্রেসকিপশান চালিত হয়ে ক্রমশ: বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে নিজেদের জন্য অনিবার্য করে তুলেছে। বিশ্বায়ন ব্যবস্থার পরিচালক উন্নত রাষ্ট্রগুলো অপরদিকে বিশ্বায়ন ব্যবস্থার সেবা দাস ও শ্রমিক হয়েছে দরিদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জনগণ।
রোখসানা আফরিন : ক্ষতিকর বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে কীভাবে বিশ্ববাসীর নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য করা যায় ?
রতনতনু ঘোষ: বিদ্যমান বিশ্বায়ন ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছে পৃথিবীর প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে বিশের ষাট শতাংশ মানুষ বিশ্বায়নের বিপদ ও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।। বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে ইতিবাচক করতে হলে গণতান্ত্রিক, মানবিক, সমতাভিত্তিক ও বৈষম্যহীন করতে হবে। বিশ্বায়নের প্রভুরা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোতে অবাধে ও বিনা ভিসায় ঢুকছে। কিন্তু দরিদ্র ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জনগণ উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ঢুকছে পাসপোর্ট ভিসার কড়াকড়ি এবং কঠোর শর্তাবলী মেনে নিয়ে। প্রবাসী শ্রমিকদের যে কোনো মূহুর্তে উন্নত রাষ্ট্রগুলো থেকে বের করে দিচ্ছে তাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে। এই বৈষম্য বজায় রেখে বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে ইতিবাচক করা যাবে না। এছাড়া উন্নত দেশগুলো তাদের জনগণের জীবন-মান, নিরাপত্তা ও বিকাশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে। অথচ দরিদ্র ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জনগণ বেকারত্ব, দারিদ্র, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির দু:শাসনের অসহায় শিকার হচ্ছে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের শাসকেরা নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে আর্থ-রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশ্বায়নের সুযোগগুলো ভোগ করছে। এভাবে বিশ্বায়ন প্রভুদের পক্ষে সেবাদাস হয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রের সরকারগুলো জনগণের নিকট দু:শাসক ও শোষক হয়ে উঠছে। ক্ষুদ্র ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর শাসকশ্রেণীর এ ধরণের গণবিরোধী ও ভোগবিলাসী চরিত্র বজায় রেখে বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে ইতিবাচক করা যাবে না। উন্নত রাষ্ট্রের মানবিক গণতন্ত্র আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর নৃসংশ গণতন্ত্র এক নয়। অন্যদিকেজ উন্নত দেশের বিকাশমান পুঁজিবাদ আর উন্নয়নশীল দেশের অবদমিত পুঁজিবাদ এক নয়। কাজেই উন্নত দেশের বিশ্বায়ন ব্যবস্থা নিয়ে জনগণ যেখানে সুফল ভোগী সেখানে অনুন্নত দেশের জনগণ নেতিবাচক বিশ্বায়নের কবলে পড়ে পর্জুদস্ত ও অসহায়। ক্ষুদ্র ও দরিদ্র রাষ্ট্রের স্থানীয় পুঁজি বিশ্ব পুঁজির অধীনতায় অসহায় ও প্রবৃদ্ধিহীন। অন্যদিকে উন্নত রাষ্ট্রের স্থানীয় পুঁজি কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় পুঁজির রূপে প্রবৃদ্ধিমান। পুঁজির এই স্থানীকতা ও কেন্দ্রিকতার চরিত্র বজায় রেখে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো বিশ্বায়ন ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলো ভোগ করতে পারবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্বৃত্তায়ন কবলিত রাজনীতি, দুর্নীতি কবলিত অর্থনীতি, রাজনীতিহীন রাজনীতি, সন্ত্রাস সম্প্রসারণ করে দেশে দেমে সন্ত্রাসের বিশ্বায়ন ঘটানো যায় কেবল। বিশ্বায়ন ব্যবস্থার কুফলগুলো দূর না করলে বিশ্বায়নকে বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক গ্রহণযোগ্য ও মানবিক করা যাবে না।
রোখসানা আফরিন : এতো বিষয় থাকতে বিশ্বায়ন রাজনীতি নিয়ে কেন বই লিখতে উদ্বুদ্ধ হলেন ?
রতনতনু ঘোষ: সামন্তবাদ প্রথা অতিক্রম করে এসেছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ কুফলগুলো নিরসনের জন্য এসেছে সমাজতন্ত্রবাদ। আবার পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের অবক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য অবলম্বন করা হয়েছিলো কল্যান রাষ্ট্র ব্যবস্থা। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ সামাজ্যবাদের ছোবল থেকে রক্ষার কথা বলে ভদ্রবেশী সামাজ্যবাদ আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বায়ন ব্যবস্থা রূপে। রাশিয়া ভাঙন ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলুপ্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী এককভাবে রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রভু হয়ে উঠেছে। অপ্রতিন্দ্বন্দ্বী হয়ে কিছু উন্নত রাষ্ট্রকে অংশিদার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককেন্দ্রিক আর্থরাজনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার প্রর্বতন ঘটিয়েছে বিশ্বায়ন তথা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বলা যায় বিশ্বায়ন মতবাদ বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনের সর্ববিস্তারী প্রভাবক ও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। কাজেই বিশ্বায়ন মতবাদকে এড়িয়ে বর্তমানের কোনো বিষয়কেই ব্যাখা করা যাবে না। লেখকের কাজ মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও স্বদেশ নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক বক্তব্য তুলে ধরা। বিশ্বায়ন মতবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে কোনো লেখকই আজ আর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্যের সম্পূর্ণতা প্রকাশ করতে পারে না। আমি চেষ্টা করছি বিশ্বায়ন মতবাদকে কঠিন অবস্থা থেকে তরল ভাবে তুলে ধরতে। বিশ্বায়নের অনিবার্য দুর্ভোগ ও দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এর নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছি। ইতিহাসের পটভুমিতে বিস্ময়কর বিশ্বায়নকে ব্যাখ্যা করেছি। এছাড়া বিশ্বায়নের প্রভুদের বিশ্বব্যাপী আর্থ রাজনৈতিক তৎপরতার সামগ্রিক দিক তুলে ধরে বিশ্বায়নের বাস্তবতা, ইতিবাচক সম্ভাবনা ও বিশ্ব সমাজতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছি। বিশ্বায়ন যদি হয় আমেরিকায়ন তাহলে পৃথিবীর রাজধানী হয়ে উঠবে আমেরিকা। ফলে আমেরিকা ভিত্তিক বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণের নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতিই কেবল সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। আমি চাই সমগ্র বিশ্বকে যেন মুক্তবাজারের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে না হয়। সেই উদ্দেশ্যে মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল লেখকদের কাজ করতে হবে। বিশ্বায়নের মতবাদ না জেনে এ যুগে সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুশীলন করাও ফলপ্রসূ হতে পারে না। সাহিত্যের বিশ্বায়ন, সংস্কৃতির বিশ্বায়ন, রাজনীতির বিশ্বায়ন ও অর্থনীতির বিশ্বায়ন না জানলে অনুগ্রসর ও কৃপম-ুক লেখক হয়েই থাকতে হবে। এইজন্য বিশ্বায়নের সামগ্রি ধারণাকে নিজস্ব বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিকোন থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর -ে----- সেরা লেখকই সাম্প্রতিক সময়ের তাত্ত্বিক উত্তাপ ও জনগণের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন না হয়ে পারেননি। বিশ্বায়ন ব্যবস্থা আমাদেরকে গ্রাস করবে আর আমরা বিশ্বায়নের প্রভুত্বের অধীনে ক্রমাগত বিলীন হবো এই মনোভাব নিয়ে যেকোন সার্বভৌম লেখকসত্তা বিকশিত হতে পারে না। এইজন্য চাই বিশ্বায়ন সম্পর্কিত সুস্পষ্ট জ্ঞানের অধ্যয়ন ও অনুশীলন। চাই ব্যাপক পঠন ও পাঠন। আমি বিশ্বায়ন ধারণাকে শুধু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ না করে আর্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার নয়া দস্যূতা হিসেবে চিহ্নিত করেছি। যে বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী অনিবার্য হয়ে উঠেছে সেই বিশ্বায়নকে ইতিবাচক রূপে সংশোধিত ও পুর্ণগঠিত করতে না পারলে লেখকসত্তার জনকল্যাণকামিতা অসম্ভব প্রায়।
রোখসানা আফরিন : মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে বিশ্বায়ন কীভাবে সম্পকিত ?
রতনতনু ঘোষ: মুক্তবাজার ও অবাধ অথনীতির পথ ধরেই এসেছে বিশ্বায়ন। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিফ মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা। তার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়েছেন অনেক পুঁজিবাদী ওে উপযোগবাদী অর্থনীতিবিদ। মুক্তবাজার বিশ্বায়নের পূর্ববর্তী স্তর। বিশ্বায়নের লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বকে বাজার বানিয়ে বিশ্বব্যাপী আর্থ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে বিশ্ববাজারকে মুক্ত করতে তৎপর রয়েছে বিশ্বায়নবাদীরা। বলা যায় মুক্তবাজার বিশ্বায়নের সহায়ক। মুক্তবাজার মুলত: বিশ্বায়নকেই ত্বরান্বিত করে। বিশ্বায়নকে ইতিবাচক করতে হলে চাই গণতান্ত্রিক, মানবিক ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্বায়ন ব্যবস্থা। সেটা সম্ভব হতে পারে বিশ্বায়নের কুফলগুলো দূর করে ইতিবাচক বিশ্বায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। সার্বজনীন ইতিবাচক বিশ্বায়ন ছাড়া বিশ্বায়ন ব্যবস্থা টেকসই হবে না। সার্বজনীন ইতিবাচক বিশ্বায়ন ব্যবস্থা বলতে বিশ্বায়নের সুফলগুলোকে সকলের নিকট পৌঁছা নোর ব্যবস্থা করাকে বোঝায়। অর্থাৎ শুধু উন্নত দেশের জন্য নয় বরং পৃথিবীর সকল দেশের জন্যই বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য ও কল্যাণকর করতে পারলে পৃথিবী হবে বিশ্ব নাগরিকের স্বদেশ।
রোখসানা আফরিন : ইতিবাচক ও সার্বজনীন বিশ্বায়ন ব্যবস্থা কি আদৌ সম্ভব ?
রতনতনু ঘোষ: আমরা বিশ্ব পরিবেশবাদী আন্দোলনের কথা বলি। বিশ্ব মানবতা ও বিশ্বসংস্কৃতির কথা বলি। বিশ্ব রাষ্ট্রের ধারণা নতুন নয়। আন্তর্জাতিকবাদ পেরিয়ে বিশ্বকে সকল মানুষের জন্য অবাধ করা এবং অবাধ বিশ্বকে সকলের জন্য সহায়ক করতে পারলে পৃথিবী নামক রাষ্ট্র হবে বিশ্ববাসীর বিচরণক্ষেত্র। জাতিসংঘের নেতৃত্বে জাতিসত্তার স্বীকৃতি বজায় রেখে আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বায়নবাদীরা চাচ্ছেন জাতিসত্তার, জাতীয় সংস্কৃতি বিলুপ্ত করে সমগ্র বিশ্বকে একাকার করতে। এ ব্যাবস্থার প্রভু রাষ্ট্রের কর্তৃত্বও আধিপত্য চরম আকার ধারণ করছে বলে বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন হয়েছে সিয়াটলের দিল্লীতে ও অন্যান্য স্থান। যতোই বিরোধিতা করা হোক না কেন বিশ্বায়ন ব্যবস্থা বাইরে আজ কেউ নেই। আর এই বিশ্বায়নের প্রভাব বলয় এড়িয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বিশ্বায়নকে স্বীকৃতি দিয়ে এককেন্দ্রিক ও নেতিবাচক বিশ্বায়নের বদলে সার্বজনীন ইতিবাচক বিশ্বায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিশ্বেও বিভিন্ন রাষ্ট্রে সরকারগুলোকে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বৈষম্যমুক্ত আগামী বিশ্বায়ন ব্যবস্থার লক্ষ্যে। ভাঙনবাদী বিপ্লব ও নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক তৎপরতার বদলে সম্মিলিত আলোচনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করাই বিশ্বায়ন ব্যবস্থার লক্ষ্য। এক্ষেত্রে বিশ্ববিপ্লব সাধিত হচ্ছে মানবচেতনায় এবং আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীর ধারাবাহিকতায়। রাজনৈতিক বিকল্প হয়ে উঠেছে আলোচনা-সমালোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, মত-বিনিময়, কৌশলপত্র তৈরী, সম্মিলিত অংশগ্রহণ, মতৈক্য প্রতিষ্ঠা, জোটবদ্ধতা প্রভূতি। সুশীল সমাজ, প্রচার মাধ্যম (বৈদ্যুতিক ও মুদ্রিত) ও আর্থ রাজনৈতিক সংস্থাসমূহ, রাজনৈতিক দল ও মুক্তচিন্তাবাদী লেখক, দার্শনিক, সংস্কৃতিসেবী। উন্নয়নকর্মী ও জনসমাজ গঠনকারী শক্তি ও আজ জনগণের রক্তস্রোত অপেক্ষা ক্ষতিমুক্ত বিপ্লবাত্মক চিন্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এজন্য আগ্রাসী শক্তিকে মোকাবেলা করতে হলে চিন্তা-চেতনায়, ভাবাদর্শে-উন্নত হতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান ক্ষেত্রে অনগ্রসর হলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকা যাবে না। উন্নয়ন ও বিকাশের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজন চিন্তার বিপ্লবকে কর্মের বিপ্লবে রূপান্তরিত করা। কাজের মধ্য দিয়েই আমাদের কর্ম বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই বিশ্বায়নকে ইতিবাচক ও অগ্রসর করে তোলা সম্ভব।