পৃষ্ঠাসমূহ

জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে শান্তিপূর্ণ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই'

জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে শান্তিপূর্ণ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই'
রতনতনু ঘোষ প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট ও রাজনীতির বিশ্লেষক। তিনি দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, জনগণের আকাক্সক্ষা ও বিশ্বায়ন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন। বিশ্বায়নের রাজনীতি, মুক্তচিন্তা, স্বদেশ, সমাজ, সাহিত্য, মানুষের স্বরূপ, মানুষ কেন্দ্রিক জগৎ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন। তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন হাফিজুর রহমান হাফিজ।
হাফিজুর রহমান : সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের কারণে পাকিস্তান টিকেনি। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের খোলস্ থেকে বেরিয়ে এলো স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলা ভাগের মাধ্যমে একটি নতুন রাষ্ট্রের উত্থান, পতন ও স্বাধীনতা লাভের যে আকাক্সক্ষা ছিল জনগণের সে সম্পর্কে আপনার অভিমত কি ?


রতনতনু ঘোষ : দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে বাংলাদেশ ভাগ হয়েছিল মুসলিম ঐতিহ্যের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা এবং পৃথক একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমে জাতিসত্তার বিকশিত ধারা অব্যাহত রাখার জন্য। ভারত ভাগ হলো। কিন্তু নব্য পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ববাংলার মুসলমানদের নিকট আশা ভঙ্গেও কারণ হলো অল্পদিনের মধ্যেই। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ, শোষণ ও বঞ্চনার ফলে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। তারা বিক্ষুদ্ধ হলো; পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজস্ব একটি সরকার গঠনের প্রবল দাবি তুললো এবং শৃঙ্খলা মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত হলো। আটচল্লিশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উঠলো। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে জনগণ স্বত:স্ফুর্তভাবে অংশ নিল। ছাপান্ন সনে বাংলাভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ঘটলেও সেনাশাসনের যাঁতাকলে ক্রমশ নিস্পেষিত হতে শুরু করলো বাঙ্গালী। ’৬৪ সনে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধানো হলো সরকারী মদদে। এরপর থেকেই বাংলার রাজনীতিতে গণ-আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার শুরু হলো। উতপ্ত সেই সময়ে দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী জনকন্ঠ আরো স্বোচ্চার হলো। ছয় দফা, ১১ দফা পেরিয়ে আন্দোলন রূপ নিল এক দফায়। ’৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে সূচনা ঘটলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ, গণহত্যা, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও ভয়াল নির্যাতনের পর পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হলো। বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জিত হলো এবং পাকিস্তানের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠিত হলো। বারবার এদেশের জনগণ আশাহত হয়েছে ক্রগাত দু:শাসনের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্র ভাঙ্গা, গড়া ও পুনরূত্থানের মাধ্যমে। পাকিস্তান হলো কিন্তু বাঙালী মুসলমান নতুন কৌশলে শোষিত হতে থাকলো পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর মাধ্যমে। ফলে পূর্ব বাংলার অনিবার্য বিভক্তি ঘটলো পাকিস্তান ভেঙ্গে একটি স্বাধীন রাষ্টসত্তার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন থেকে বাঙালী স্বশাসনে প্রবেশের সুযোগ পেলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার আদর্শ নিয়ে যে বাংলাদেশ গঠিত হলো সেটি ভুলুণ্ঠিত হলো পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার মাধ্যমে। জাতীয় চারনেতাকে নিমর্মভাবে জেলখানায় হত্যার মাধ্যমে। দেশে ফিরে এলো অবৈধ সেনাশাসন আর পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পুরনো ধারা। রাজাকাররা বহুদলীয় রাজনীতির সুযোগে ক্রমবিকশিত হলো দীর্ঘ সাময়িক শাসনের ছত্রছায়া ও আনুকূল্যে। আজ তারা জোট সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনীতির অংশীদার। অথচ এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজাকারতন্ত্রের বিরুদ্ধে। অসাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও অঙ্গীকার ছিল বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে জনগণকে মুক্তি দান। ‘৬৫- সনের ‘শত্রুসম্পত্তির আইন’ স্বাধীন বাংলাদেশও বহাল থাকলো নানা নামে। সংবিধানের সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো হলো ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করে। ইনডেমনিটি এ্যাক্ট করে কালো রাজনীতির মাধ্যমে খুনিদের প্রতিষ্ঠিত করা হলো। সংবিধানকে এভাবে কলঙ্ক্তি করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা ব্যাহত করা হলো। মুক্তিযোদ্ধারা আজ স্বাধীন দেশে থেকে পরাধীন দেশ অপেক্ষা অধিক অসহায় ও নির্যাতন লাভ করলো। তারা গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের নোংরা রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়েছে। জনগণ আজ অনিরাপত্তা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মৌলবাদের উত্থানে জর্জরিত। অস্ত্র, হত্যা, বোমা, ক্যাডার, নিপীড়ন, দলীয়করণ এগুলো রাজনীতির প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে। জনগণের অসহায়ত্ব পূর্বাপেক্ষা বহু গুনে বেড়েছে। শাসকশ্রেণী দেশটাকে দু:শাসনের ভূখন্ডে পরিণত করেছে। দেশ আজ সন্ত্রাসী ভূখন্ডরূপে, অকার্যকর রাষ্ট্ররূপে চিহ্নিত। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণ এ ধরণের বাংলাদেশ গঠনের আকাক্সক্ষা করেনি। বিদেশী দু:শাসনে থেকে ধারাবাহিক শোষণের কবলে ক্রমনি:শোষিত হওয়ার আকাক্সক্ষা জনগণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও জনমতের বিপরীতেই আজ দেশ শাসিত হচ্ছে। সুশাসনের অভাবে ব্যর্থ সরকারের দায়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, গভীর অন্ধকারগামী।
হাফিজুর রহমান : মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার যথার্থ বিকাশের মাধ্যমে কি আজকের এই দু:সহ, অনিরাপদ বাংলাদেশ চেয়েছিল জনগণ ?
রতনতনু ঘোষ : মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। যে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল বাঙালী জনগণ তাকে বিকশিত করার জন্য অপরিহার্য অবলম্বন ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা। নানা স্তরে নানা যাত্রায় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা রাষ্ট্রীয় জীবনের অবলম্বন হতে পারেনি স্বৈরশাসনের অভিঘাতে। দেশ সুশাসনে সরকারের ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশ অকার্যকর রাষ্ট্রসত্তা হয়েছে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ পরিণতি ঘটেনি, অগ্রসর হতে পারেনি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, এদেশে সরকারগুলো ব্যাপক ব্যর্থতা আছে কিন্তু দেশের জনগণের জীবনসংগ্রাম ও যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও বিজয়মুখী তৎপরতা আছে। সরকার বদল হয় দ্রুত কিন্তু রাষ্ট্রসত্তা দীর্ঘস্থায়ী, তা রাজনৈতিক ও ভৌগলিক ব্যাপার। সহজে-এর বদল হয় না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় কখনো দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, বৈষম্য, দারিদ্র অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ ছিল এসব ক্ষতিকর ও নেতিবাচক বিষয় থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা অবলম্বন করলে সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, কালো আইনগুলো সংযোজিত হতে পারতো না। দেশে রাজাকারদের রাজনীতি আর রাজনীতির রাজাকারায়ন ঘটেছে যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভিত্তিক যে বৈষম্য রয়েছে তা জনগণের বিকাশবিরুদ্ধ, ব্যাপক আর্থ-সামাজিক বৈষম্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীতে। রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করে সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়েছে সরকার। অথচ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করা। কোনো সেনা সরকারই মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ আদর্শ ও চেতনা উপলব্ধির চেষ্টা করেনি। সেই শাসকজাত সরকারগুলোও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনার পরিপন্থি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও তৎপরতার সূত্রে ক্রমবিকশিত যে বাংলাদেশ তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ পরিণতি হতে পারেনি। এদেশে যারা দু:শাসনের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার, যারা সরকারের ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, যারা জনমতের পক্ষে কাজ করে, যারা মানবাধিকার পক্ষে কথা বলে, যারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্দে জনগণকে সচেতন করে, প্রতিবাদী করে, তারাই আজ সরকারের চিহ্নিত শত্রুপক্ষ। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই আজ সরকারী তালিকায় দেশদ্রোহীরূপে চিহ্নিত। সরকারের বিরোধীকারীগণই রাজনৈতিক নিপীড়নের দিকে জোট সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, প্রতিকী প্রতিবাদের তাৎপর্য বুঝতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন সিভিল সমাজ তথা গণপক্ষের সক্রিয় শক্তির বিরুদ্ধে সরকারী তৎপরতা বিদ্যমান। যে গণবিরোধী সরকার বেশি ভয় পায় গণপক্ষের শক্তিকে। এজন্য অধ্যাপক, সাংবাদিক, আইনজীবি, ও প্রকৃত রাজনীতিকদের দমন ও নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট ও সর্তক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিমাত্রই আজ সরকারের তৎপরতায় অসহায় ও আক্রান্ত, এ অভিযোগ জনগণের। এজন্য বর্তমান বাংলাদেশকে দেশের পরিস্থিতিকে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ পরিণতি বলা যায় না। এখনকার বাংলাদেশ হলো শাসক গোষ্ঠীর কালো তৎপরতায় নির্মিত একটি নেতিবাচক ভাবমুর্তিসম্পন্ন দেশ, যেখানে কালো শাসকেরা জনগণের উপর বিজয়ী হয়ে আছে দু:শাসন ও নিপীড়নের মাধ্যমে। বিদেশীপ্রভূদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত সরকার স্বদেশের জনমতকে খুব কম গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারগুলো এবং তাদের নিয়ন্ত্রক প্রভূরা বাংলাদেশকে যেভাবে গঠিত ও বিকশিত করতে চেয়েছে আজকের বাংলাদেশ হলো সেই রূপরেখা ও আর্দশের ছাঁচে গড়া। এ বাংলাদেশ গণচেতনায় চালিত নয় এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিকশিত জনগণের বাংলাদেশ হয়ে ওঠেনি। এটি শাসক-প্রশাসকদের গড়া দুর্নীতিদৃষ্ট দেশ, সন্ত্রাসের ঝুঁকিপূর্ণ ভূ-খন্ড। জনগণের আবহমান বাংলাদেশ এটি নয়। নাগরিকদের স্বনির্ভর-সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ আজো গড়ে ওঠেনি। নানা বৈষম্যে জর্জরিত, রাজনৈতিক নোংরামিতে পরিপূর্ণ, বেকারত্বে আছন্ন এবং বোমাতঙ্কের উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ কখনো কামনা করেনি এদেশের জনগণ।
হাফিজুর রহমান : যে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি তারাই আজ কি করে দেশের সরকার গঠনে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলো ?
রতনতনু ঘোষ : স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজনীতি করার সুযোগ পেলো। তারা সুকৌশলে বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করেছে আবার আওয়ামী লীগের ঘারেও সওয়ার হয়েছে। ঘাতকচক্র নিয়ে স্বৈরাচার পতন ঘটানো হলো। তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে সরকার ব্যবস্থার বদল ঘটলো না। ফলে পরবর্তী পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে জামায়াতে ইসলামী দল জোট সরকারের ক্ষমতার অংশীদার হলো। এ অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ই দায়ী।
হাফিজুর রহমান : বাংলাদেশ অতিক্রম করছে চরম ক্রান্তিকাল। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, বেকারত্ব নিয়ে এদেশ আজ চরমভাবে বিপন্ন। এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি ?
রতনতনু ঘোষ : এ দেশে সরকারী পর্যায়ে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি শিকড় গেড়েছে। সরকারের সকল পর্যায়ে দুর্নীতির ধারা প্রবাহিত হয়ায় বিশ্বে চতুর্থ বারের মতো শীর্ষ দুর্নীতির অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বিগত নির্বাচনে জোট সরকারের নির্বাচনী ইস্যু ছিল দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমন। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনের আশায় জনগণ জোট সরকারকে নির্বাচিত করলেও দুর্নীতির দু:সহ অবস্থা এবং সন্ত্রাসের তা-ব থেকে জনগণ মুক্ত হতে পারেনি। অপারেশন ক্লিনহার্ট, র‌্যাব, চিতা, কোবরা দিয়ে সন্ত্রাসী কিছুটা দমন হলেও তা সন্ত্রাস দমনের স্থায়ী ব্যবস্থাবলে মেনে নেয়া যায় না। কারন নির্বিচারে হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করছে। বিরোধী দলের কন্ঠকে স্তব্ধ করার আয়োজন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিপন্থি কাজ করা হচ্ছে। দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ব্যতীত যুব সমাজে সন্ত্রাস দমন করা যাবে না। সন্ত্রাসের রাজনৈতিক ভিত্তি দূর না করলে সন্ত্রাস দূর হবে না। দেশ আজ প্রয়োজন নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমন মন্ত্রণালয়, মানবাধিকার মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীন বিচার বিভাগ, ন্যায়পাল গঠন করতে সরকারের গড়িমসিকে জনগণ ভালো চোখে দেখে না। সুশাসন করার জন্য সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। বিরোধীদলকে উপেক্ষা করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। পার্বত্য সমস্যা, সংখ্যালঘুর সমস্যা, দারিদ্র্যের সমস্যাগুলোকে জাতীয় ইস্যু না করলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতি ও বিভক্তি থাকবেই।
হাফিজুর রহমান : রাজনৈতিক বিভক্তি, মতাদর্শকে বিভক্তি দেশকে কিভাবে অনুন্নত ও অগ্রসর করে ?
রতনতনু ঘোষ : স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছে। সব সরকার কিন্তু তা বাস্তবায়ন করেনি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারীরা ক্ষমতায় গিয়েও রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস ও স্বৈররাজনীতি দূরীকরণে সচেষ্ট হয়নি। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো জনগণ ও দেশের কথা বিবেচনা করে ঐক্যমত্যভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণেও ব্যর্থ। শুধু ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা ভোগ ও উপর্যুপরি পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি চলছে বাংলাদেশে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুশীলন নেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। জাতীসত্তায় হিন্দু-বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান প্রতিনিধিত্ব নেই বলে সাম্প্রদায়িক সরকার গঠিত হয়েছে। সংবিধানের কালো আইনগুলো বাতিল হয়নি বলে সংবিধান বিপর্যস্ত হয়েছে। রাষ্টধর্ম বিল বাতিল না হওয়ায় সংবিধান ও সাম্প্রদায়িক হয়ে আছে। পার্বত্য সমস্যার সমাধান সঠিকভাবে হয়নি বলে অভিযোগ আছে। দারিদ্রব্যবসা করে সরকার ও এনজিওমহল। দারিদ্র্য বিমোচনে ও কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ সফল হয়নি। কর্মসংস্থান সংস্কুচিত হয়েছে অথচ জনসংখ্যা বাড়ছে। দারিদ্রের নামে প্রচুর বিদেশী সাহায্য এনে সেগুলো কুক্ষিগত করে ধনী আরো ধনী হয়েছে। এ অবস্থায় দেশ অগ্রসর ও উন্নত হওয়ার অন্তরায়।
হাফিজুর রহমান : বিশ্বায়নের সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান ও প্রস্তুতি কিরূপ ?
রতনতনু ঘোষ : বিশ্বায়িত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশ অনেকটা অনগ্রসর। ইতিবাচক আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কারের বদলে এখানে বিশ্বব্যাংক ও আই,এম,এফ কর্তৃক নতজানু উদারীকরণ ব্যবস্থা ও সংস্কার সাধিত হয়েছে। সরকার জাতীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে নজর না দিয়ে বিশ্বায়নের প্রভুদের নীতিমালা বাস্তবায়ন করছে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়েনি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারনে। নাশকতামূলক ঘটনাও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা কমেনি। বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় পরস্পরনির্ভর রাজনৈতিক তৎপরতায় সংলাপের মাধ্যমে সংসদকেন্দ্রিক যে রাজনীতি চালু হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি। দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্র সংসদকে পাশ কাটিয়ে করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দায়মুক্তি ও বির্তকিত। এছাড়া আওয়ামী আমলে প্রদত্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দায়মুক্তি ও কোনো সুফল বয়ে আনে নি। সরকার গণতান্ত্রিক বিশ্বায়ন, ইতিবাচক বিশ্বায়ন ব্যবস্থা গঠনে প্রস্তুতি নেয়নি। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলোকে সরকার ভয় পায়। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকার ধীরলয়ে এগুচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কথা মুখে বলে। কোন অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকারই এদেশে জনগণের সুশাসক হিসেবে ভাগ্যবিধাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারেনি। দলীয় সরকার হয়েই জনগণের জন্য কাজ করেছে। জনগণের সরকার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি এদেশের একটি সরকারও। গডফাদার, সন্ত্রাসী, দলীয়করণ ছিল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ। রাজনৈতিক অনৈক্য, বিভেদ, অসহিষ্ণুতার কারনে জনগণের ইস্যু উপেক্ষিত হয়েছে। কোনো সরকারই বিরোধী দলকে, তাদের সমালোচনাকে সহ্য করতে পারে না। ফলে দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে। সরকারের অভ্যন্তরী দুর্নীতি দমনে সচেষ্ট হয়নি সরকার। সন্ত্রাসীদের বিক্রুট করা আজো বন্ধ করেনি রাজনৈতিক দলগুলো। সশস্ত্র রাজনীতির কারনেই এদেশে সন্ত্রাস, মৌলবাদি, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য ভিত্তি পেয়েছে। কালো টাকাওয়ালা, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী ও ঋণখেলাপীরা আজো জনগণের ভাগ্যবিধাতা এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে আছে। দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়ের শাসন এজন্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। ক্যাডার বুদ্ধিজীবি, সন্ত্রাসী ক্যাডার দিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে দমানোর ব্যবস্থা আজো আছে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অনুশীলন করেনা রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনে মনোনয়ন বিক্রিও বন্ধ হয়নি। শুধা পরনির্ভরতা নিয়ে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে না। গলিত রাজনীতি নিয়েও বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে না। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন ও দুর্নীতি বন্ধ করে জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বসে করণীয় স্থিও করতে হবে। জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে শান্তিপূর্ণ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।