পৃষ্ঠাসমূহ

'বাংলা সাহিত্যে মানবাধিকারের গুরুত্ব রয়েছে শুরু থেকেই'

'বাংলা সাহিত্যে মানবাধিকারের গুরুত্ব রয়েছে শুরু থেকেই'
প্রবন্ধ ও মননশীল চিন্তাচর্চার পরিসর সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রকে যারা সমৃদ্ধ করে চলেছেন রতনতনু ঘোষ তাদেরই একজন। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় তার প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা সাড়ে সাত’শর অধিক। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ও সাময়িক পত্রিকাসমূহে তিনি ত্রিশ বছর ধরে ক্রমাগত লিখে চলেছেন। সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি, গণতন্ত্র, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও উত্তরাধুনিকতা তার প্রবন্ধের বিষয়। তার গ্রন্থসংখ্যা প্রায় চল্লিশ। অচিন্ত্য চয়ন মুখোমুখি হয়েছেন রতনতনু ঘোষের।
অচিন্ত্য চয়ন : সমকালে এসে অনেক লেখকই নিজেকে বোদ্ধা হিসেবে দেখতে চায়। একজন লেখককে মূল্যায়ন করবেন কে, লেখক নিজেই নাকি পাঠকসমাজ ?




রতনতনু ঘোষ : প্রকৃত লেখক সমকাল পরিবেশ-পরিস্থিতির আওতায় বসবাস করলেও এবং বর্তমানের প্রভাব তার চেতনায় কার্যকর হলেও তিনি যা সৃষ্টি করেন তা মহাকালের জন্যই করেন। যদিও সকল লেখক সেটি করতে পারেন না। লেখক সমকাল পেরিয়ে মহাকাল আর মহাকাল পেরিয়ে চিরকালের বাসিন্দা হয়ে উঠেন পাঠক সমাজের চেতনায়। সেটি তার টেকসই রচনার গুণে সম্ভবপর হয়। সমকালের অনেক লেখক বহুল প্রচারিত ও বিজ্ঞাপিত হয়েও পরবর্তী কালের পাঠক সমাজের নিকট তেমন গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হন না। রচনার মধ্যে চিরায়ত দর্শন ও মানবিক অনুভূতির উষ্ণতা ও সতেজতা না থাকলে রচনা তেমন টেকসই হয় না। কালের বিচারে এবং সাহিত্যের মানদ-ে উত্তীর্ণ হতে হবে চিরায়ত রচনা হতে হলে। লেখকের আত্মমূল্যায়ন প্রয়োজন নিজের অগ্রগতি ও ত্রুটি সনাক্ত করার জন্য। লেখক আত্মসমালোচক হলে সেটি সম্ভবপর হয়। কিন্তু স্বপ্রচারিত ও দ্রুত খ্যাতিবান হওয়ার প্রবণতা তাকে পেয়ে বসলে এবং আত্মসন্তুষ্টির সৃষ্টি হলে লেখকসত্তার অপমৃত্যু ঘটে। আবার বাণিজ্যবাদিদের খপ্পরে পড়ে ব্যবহৃত হলে লেখক প্রতিভার অপচয় ঘটে। এসব বিষয়ে লেখকের আত্মসচেতনতা প্রয়োজন। মূল্যায়ন করবেন সমালোচকরা। পাঠক সমাজ কর্তৃক লেখকের রচনা গৃহীত হলে তাতেই লেখক টিকে যান। এ কাজটি অনেক সময় সমকালের পাঠক করেন না। এজন্য মহাকালের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় অনেক বড় লেখককেও। প্রচারণা ও খ্যাতির দিকে না তাকিয়ে লেখককে লিখনকর্মে নিবেদিত থাকাই শ্রেয় মনে করতে হবে।
অচিন্ত্য চয়ন : আপনার সমসাময়িকদের লেখাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন?
রতনতনু ঘোষ : সমসাময়িক লেখকরা লিখে যাচ্ছেন। মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত সৃষ্টির প্রয়োজন। সৃষ্টিপ্রাচুর্য এবং প্রতিভার উৎকর্ষ থাকলে মূল্যায়ন আসবে পাঠক সমাজের কাছ থেকেই। ইদানিং বই বেরুলে সাহিত্য সাময়িকীতে তার একটি সহজ মূল্যায়ন হয় পুস্তক-পরিচিতি অথবা গ্রন্থালোচনার মাধ্যমে। যদিও এটি মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট নয়। সমসাময়িকদের লেখা মূল্যায়ন করার মত যে আগ্রহ এবং পাঠপ্রবণতা দরকার তা আমার হয়ে উঠে না। আমি মহাকালের বিচারে কালোত্তীর্ণদের কিছু পাঠ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট। সৃষ্টির তাড়নায় কিছু লিখতে পারলে তা প্রকাশের চেষ্টা করি। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে কেউ কেউ চেষ্টা করে যাচ্ছেন পাঠকদের নিকট পৌঁছতে। তবে মানসম্মত রচনা ভাল প্রকাশকদের মাধ্যমে প্রকাশ করলে সেগুলো পাঠকদের নিকট গৃহীত হয়। স্বঘোষিত সেরাগণ সমকালেই অধিকমাত্রায় পতিত হন। সৃষ্টির ধারাক্রম অব্যাহত রাখতে হলে প্রয়োজন ভবিষ্যতের দিতে তাকানো এবং সমকালের বৈশ্বিক পরিস্থিতির উত্তাপ রচনা ধারণ করা। এ প্রক্রিয়ায় সমসাময়িকরা এগুতে পারবে। মহাকালের পথরেখায় সমকালের সৃষ্টিশীলরা সামান্য ধুলিকণা মাত্র।
অচিন্ত্য চয়ন : বাংলাদেশে এখন অনেক লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশতে ছোটকাগজের আদর্শ ও মৌলিকত্ব বজায় থাকছে না। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? এবং কোন কাগজকে আপনি প্রকৃত কাগজ বলবেন ?
রতনতনু ঘোষ : বাংলাদেশে এখন অনেক লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে এটা আনন্দের সংবাদ। আবার মানসম্মত নয় এমন লিটনম্যাগ অতিরিক্ত প্রকাশিত হলেও তাতে তেমন উপকৃত হয় না সমাজ। লিটলম্যাগ এখন শুধু লিটলদের নয়, বড়দেও এবং প্রতিষ্ঠিতদের ধারণ করছে। লিটলম্যাগকে হতে হবে নতুন, ব্যতিক্রমী, পরীক্ষাপ্রবণ রচনার ধারক ও বাহক। যা দৈনিকে প্রকাশ করা ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রতিষ্ঠিত কাগজের নিকট উপেক্ষিত তা নির্ভয়ে এবং সাদরে প্রকাশ করা যায় লিটলম্যাগে। অধিকাংশ ছোটকাগজের আদর্শ ও মৌলিকত্ব বজায় না থাকার কারণ হলো সম্পাদনার অদুরদর্শিতা, পরীক্ষামূলক ও নতুন ধরনের ভাল লেখার ঘাটতি। ভাল লোককাগজ বের করার জন্য প্রয়োজন আর্থিক প্রণোদনা, সৃষ্টিশীল ও তারুণ্যম-িত রচনা। নতুনের কেতন উড়িয়ে যারা বিজয়ধ্বনি করতে পারবে টেকসই লেখক সত্তা নিয়ে তাদের আগমন ঘটে ছোট কাগজের মূলধারা থেকেই। বড়রা ক্রমাগত বড় হয়ে উঠে ছোট কাগজের আনুকূল্যে ও পরিসরে। সেদিক থেকে ছোট কাগজের সামাজিক ভূমিকা ও সাহিত্যিক গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট।
অচিন্ত্য চয়ন : লেখার মাধ্যম কি সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব ?
রতনতনু ঘোষ : সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন প্রত্যক্ষ ও বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচী। কর্মসূচী তৈরী করার জন্য যে বিবেচনা ও চিন্তাভাবনা প্রয়োজন তা আসে মননশীল সাহিত্য ও প্রগতিবাদী রচনা থেকে। সমাজ সংস্কারে, সামাজিক জাগরণে, মানবিক অগ্রগতি সাধনে প্রয়োজন সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলন। ভাব-আন্দোলনের ভিত্তিমূলে থাকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি। শক্তিশালী লেখার মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন সাধিত হয় বলেই লেখকদের মুক্তচিন্তায় বাধা আরোপিত হয়। লেখকের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয়। বিদ্রোহী লেখকদের গ্রেফতার ও দেশান্তরি করা হয়। লেখকের মানবিক চিন্তাধারা সমাজের অগ্রগতির সহায়ক। শাসকগোষ্ঠী শোষণ প্রবণতা ও শৃঙ্খল লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এজন্য লেখকের উপর নেমে আসে দুঃশাসকের নিষেধাজ্ঞা ও নিপীড়ন। লেখকের মৃত্যুদ- নতুন ঘটনা নয়। আড়াই হাজার বছরের গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস থেকে শুরু করে এযাবৎ কালের অনেক উন্নত রাষ্ট্রেও লেখক নিপীড়নের ঘটনা সংঘঠিত হয়েছে। মার্কস, এঞ্জেলস, ভলতেয়ার, রুশো, টমাস পেন, রবীন্দ্রনাথ, বায়রন, নজরুল এর রচনার মাধ্যমে এসেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।
অচিন্ত্য চয়ন : সভ্যতার সংঘাত মোকাবেলায় লেখকদের ভূমিকা কিরূপ হওয়া উচিত ?
রতনতনু ঘোষ : লেখকরাও সভ্যতার সৃষ্টির জন্য সক্রিয়। এ ব্যাপারে তারা চিন্তাগতভাবে সক্রিয় থাকেন। সভ্যতার বিপর্যয় ও গ্লানিতে সর্বাধিক উদ্বিগ্ন হন লেখকরা। দার্শনিক বারট্র্যান্ড রাসেল, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভ্যতার সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কি করে বিশ্বকে অস্ত্রমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত ও সংঘাতমুক্ত করা যায় সে ব্যাপারে তারা কার্যকর সংলাপ করেছেন। জাতিসংঘ এখন বিশ্ব শান্তি দিবস পালন করে। এ শান্তির আকাক্সক্ষায় যারা ললিত বাণী সৃষ্টি করেছেন তারা মানব জাতির হিতাকাক্সক্ষী লেখক। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’, এস.পি হান্টিংটন এর ‘দ্য ক্লেশ অফ সিভিলাইজেশন’, টমাস পেনের ‘রাইটস অফ ম্যান’, জন মিল্টনের ‘এরিওপ্যাজিটিকা’ গুরুত্বপূর্ণ রচনা সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে ভিত্তি করে রচিত।
অচিন্ত্য চয়ন : মানুষের চেতনা রূপান্তরে কোনটি অধিক কার্যকর সাহিত্য নাকি প্রযুক্তি ?
রতনতনু ঘোষ : সাহিত্যের কাজ মানুষকে আনন্দ দান, রসসিক্ত করা, চেতনা পুনর্গঠন করা এবং চিত্তকে বিনোদিত করা। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ মানুষের উন্নয়নকে সম্প্রসারিত করে। তথ্যপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, জ্ঞানপ্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে মানুষের বহুমাত্রিক উন্নয়ন সম্ভবপর হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের হাতিয়ার হওয়ায় সাহিত্য বিকাশের পরিসর বেড়েছে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগে ইলেকট্রনিক সাহিত্য অনুশীলনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাগুজে বইয়ের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক গ্রন্থাদির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে পাঠকের। প্রযুক্তি সাহিত্য বিকাশের সহায়ক। তা সাহিত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু নয়। মানুষের চেতনা রূপান্তরে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুহুর্তের মধ্যেই বিনা পাসপোর্টে অর্থাৎ অবাধে প্রবেশ করা যায় লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসে অথবা অন্য কোথাও। জ্ঞান অনুশীলনের এই যে সুযোগ এতে তো সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো ঢুকে গেছে। গুগলে সার্চ দিলে সহজেই পাওয়া যায় দুলর্ভ সব ডকুমেন্টস্ ও পাঠবস্তু। প্রযুক্তির কারণে এখন সাহিত্য হয়েছে জ্ঞানপণ্য অথবা মেধাসম্পদ। সুতরাং পাঠকের চেতনা নির্মাণে ও পুনর্গঠনে সাহিত্য ও প্রযুক্তি উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে।
অচিন্ত্য চয়ন : গ্রামীণ সাহিত্য ও শহুরে সাহিত্য বলে কোনো বিভাজন আপনি মানেন ?
রতনতনু ঘোষ : গ্রামীণ পটভূমি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা অবলম্বনে রচিত উপন্যাস, কবিতা, গল্প, নাটককে বলা হয় গ্রামীণ সাহিত্য। বাংলাসাহিত্য জুড়ে গ্রামীণ পটভূমিতে সৃষ্ট অনেক উপন্যাস রয়েছে। আমি মানি আর নাই মানি গ্রামীণ ও শহুরে সাহিত্য বলে একটি বিভাজন রয়েছে। বাস্তবে এবং চূড়ান্ত বিচারে উভয়ই সাহিত্য। এখন গ্রামীণ লোকসাহিত্যের গুরুত্বও কম নয়। গ্রামীণ সংস্কৃতি ও জীবনআচার গ্রামীণ সাহিত্যের মধ্যে রূপায়িত। নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনের, সহজ-সরল গ্রামীণ মানুষের অনুভূতি, গ্রামীণ মাতব্বর শ্রেণীর প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামীণ সাহিত্যে। তাছাড়া গ্রামীণ পারিবারিক জীবন ও কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, ধর্মপ্রভাবিত, জীবনসংস্কৃতি ও প্রকৃতিনির্ভরতা উঠে এসেছে গ্রামীণ সাহিত্যে। এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও বিশ্লেষণ আছে। শহুরে সাহিত্য বলতে মনে করা হয় অভিজাত সাহিত্য। শহুরে-শিক্ষিত লোকদের জীবনধারা, সামাজিক জটিলতা, শিল্পায়ন ও শহরায়ন প্রভাবিত মানুষের মনস্তত্ত্ব প্রতিফলিত হয় শহুরে সাহিত্যে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় রয়েছে শহুরে সাহিত্যের বিস্তার। আসলে শহরে বসেও গ্রামীণ সাহিত্য রচনা করেছেন অনেকে। কবি জসিমউদ্দিনের নাম করা যায় এক্ষেত্রে।
অচিন্ত্য চয়ন : সাহিত্যের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতকে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন ?
রতনতনু ঘোষ : সাহিত্য আসলে সমাজ ও সংস্কৃতির দর্পন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয়, গতিশীলতা, প্রেক্ষাপট বিভিন্ন মাত্রা লাভ করে সাহিত্যিকের রঙতুলিতে। সাহিত্যের পাত্র-পাত্রী সমাজের বাসিন্দা। সমাজকে তুলে ধরার জন্য সাহিত্যিকের যত সৃষ্টিশীলতা। সাহিত্য পাঠে যেমন সমাজের পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি সাহিত্যের সামাজিক প্রেক্ষিত অধ্যয়ন করে সমাজকে জানা যায়। একটি সমাজ কতটুকু অগ্রসর ও পশ্চাৎপদ, কতটুকু প্রগতিশীল ও বিকশিত, কতটুকু মুক্ত ও বদ্ধ তা পরিমাপ করা যায় সাহিত্যের পরিসরে বিচরণ করে। প্রচলিত সামাজিক জীবনধারা অবলম্বন করে সমাজ রূপান্তরের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন সাহিত্যিক। এজন্য সমকালের রচিত সাহিত্যগুলোতে সমকালীন সমাজের পরিস্থিতি উঠে আসে। সাহিত্যিকরা সংস্কৃতিবান হিসেবে সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেন। মানুষের সাংস্কৃতিক মান বিকাশে সাহিত্য পরম সহায়ক। শক্তিশালী সাহিত্যপ্রতিভা শক্তিশালী সমাজ গঠনের উপায়।
অচিন্ত্য চয়ন : সাহিত্য মানবাধিকার রূপায়নের প্রবণতা আপনি সনাক্ত করেছেন ?
রতনতনু ঘোষ : বাংলা সাহিত্যে মানবাধিকারের গুরুত্ব রয়েছে শুরু থেকেই। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ (চন্ডিদাস), ‘এসব মূঢ় মুক ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা, ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান’ (নজরুল ইসলাম) এধরনের আকাক্সক্ষা যারা করেন তারা মানবতাবাদী কবি ও শিল্পী। লালন সাঁই থেকে শুরু করে একালের তরুণ কবি পর্যন্ত মানবতার জয়গানে মুখর। যেখানে মানবাধিকার বিপন্ন হয় সেখানেই কবিরা সোচ্চার উচ্চারণে ফেটে পড়েন। বাংলাসাহিত্যের বহু স্থানে মানুষের অধিকার, মনুষ্যত্ব, মানবিক আর্তি ও আকাক্সক্ষা রূপায়িত হয়েছে সাহিত্যিকদের লিখনীতে।
অচিন্ত্য চয়ন : বাংলাসাহিত্যে পরিবেশবাদের প্রভাব ও গুরুত্ব কিভাবে নির্ণয় করেন ?
রতনতনু ঘোষ : বাংলা সাহিত্যে পরিবেশবাদের প্রভাব ও গুরুত্ব ব্যাপক। পথের পাচালি, পদ্মা নদীর মাঝি, তিতাস একটি নদীর নাম, হাঁসুলী বাকের উপকথা এসব পরিবেশবাদী উপন্যাস হিসাবে পরিচিত। মানুষের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক তাতে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতি থেকে উৎসৃষ্ট হয়ে যখন পরিবেশের বিরুদ্ধে অত্যাচার করে তখনই নেমে আসে পরিবেশগত বিপর্যয়। এখন প্রকৃতিবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, সমাজবাদী, মানবতাবাদী সকলেই পরিবেশবাদী হয়ে উঠছেন। পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন জোরদার হয়েছে। পরিবেশবাদী সামাজিক আন্দোলন এখন পরিবেশ রাজনীতির সৃষ্টি করছে। মানুষের অস্তিত্বের নিরাপদ সুরক্ষা ও বিকাশের জন্যই প্রয়োজন প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষা করা। নদীর মৃত্যু, ভূমিক্ষয়, পাহাড়ধস, বৃক্ষকর্তন, বনভূমি উজাড়, পুকুর ও জলাশয় ভরাট, নদী দখল, নদী দূষণ কতটা ক্ষতিকর তা আজ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। শহরের দখলে যাচ্ছে গ্রাম। গ্রামীণ পরিবেশে স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হওয়ায় গ্রামীণ মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অকাল বন্যা, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, উষ্ণায়ন, বাতাসে কার্বন নিঃসরণ প্রভূতি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশগত অবক্ষয়, পরিবেশ দূষণ ও প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে। এসব বিষয়ে সাহিত্যিকরা নির্বিকার থাকতে পারেন না। পরিবেশবাদী সাহিত্যিকরা আসলে মানবতাবাদী। তারা মানুষ ও পরিবেশকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট। সেজন্য সাহিত্যের মধ্যে পরিবেশবাদিতা ও প্রকৃতিপ্রেম রূপায়িত হয়।