পৃষ্ঠাসমূহ

বাংলাদেশের প্রবন্ধ ও মননশীল চিন্তাচর্চার পরিসরকে যারা সমৃদ্ধ করে চলেছেন রতনতনু ঘোষ তাদের মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ ও মননশীল চিন্তাচর্চার পরিসরকে যারা সমৃদ্ধ করে চলেছেন রতনতনু ঘোষ তাদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ও সাময়িক পত্রিকাসমূহে তিনি ত্রিশ বছর ধরে ক্রমাগত লিখে চলেছেন প্রবন্ধ ও কলাম। সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি, গণতন্ত্র, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও উত্তরাধুনিকতা বিষয়ে তার গ্রন্থসংখ্যা প্রায় চল্লিশ। তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন কবি অচিন্ত্য চয়ন।
অচিন্ত্য চয়ন : বিশ্বসাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সমকালে এসেও পরিবর্তন হচ্ছে। কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক বিষয়গুলো আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?



রতনতনু ঘোষ : কবিতা মানুষের আকাক্সক্ষার শব্দরূপ, সামাজিক গতিশীলতার রূপায়ন। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরের সীমা অনুযায়ী কবিতার বিস্তার। মানুষ ও সমাজ পরিবর্তিত হয়। সেজন্য কবিতার ভাবানুষঙ্গ ও বিষয়বস্তুর বদল হয়। প্রতিনিয়ত সমাজ এবং মানুষের আকাক্সক্ষার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। মানবীয় অনুভূতি ও আকাক্সক্ষার ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে কবিরাও মানুষের সেই পরিবর্তিত চেতনাকে কাব্যভাষ্যে ধারণ করেন। সেজন্য সেকাল থেকে একালে এবং পরবর্তী কালেও কবিতার বিষয়বস্তু ও মানবীয় চেতনার অনুষঙ্গগুলোর বদল অনিবার্য হয়ে পড়ে। কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক বিষয়গুলো এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ, গ্যাটে, বায়রন, কোলরিজ, শেলি, এজরাপাউন্ড, সিমাসহিনী, নজরুল, সুনীল প্রমুখের কবিতায় বিশ্বমানবিক চেতনা মুর্ত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। আঙ্গিক ও মর্মগতভাবে সে ভিন্নতা ধরা পড়ে। মানবীয় দ্রোহ, আকাক্সক্ষা ও আবেগ সকল কালেই সকল মানুষের মধ্যে থাকে। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট, অনুষঙ্গ, বিষয়বস্তু ও পরিসর পাল্টে যায়। ফলে দেশে দেশে কবিতায় রূপায়িত একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। কবিতার বিকাশমান পর্যায়ে ও বিবর্তনগত পথরেখায় কবিতার রূপ ও স্বরূপ স্বতন্ত্র আঙ্গিক ও নতুন মাত্রা লাভ করে।
অচিন্ত্য চয়ন : সাহিত্য হলো জীবনবোধের বহি:প্রকাশ। এই বহি:প্রকাশের হাত ধরে জাতি এদেশে পার করেছে বিয়াল্লিশটি বছর। বিয়াল্লিশ বছরে আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
রতনতনু ঘোষ : সাহিত্য ও জীবন সমার্থক। বলা যায় সাহিত্য জীবনের উল্টোপীঠ। জাতীয় জীবনে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ পার করেছে বিয়াল্লিশটি বছর। এই বিয়াল্লিশ বছরে আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ও বিকাশ ঘটেছে। শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি বাংলাদেশের কাব্যভূবনকে আলোকিত করেছেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধুনিক ভাবধারায় লিখে চলেছেন, ফলাচ্ছেন কাব্যশস্য। আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, কবীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, যতীন সরকার, হুমায়ুন আজাদ, আবুল কাশেম ফজলুল হক সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাবন্ধিক ও চিন্তক পেয়েছে বাংলাদেশ। উপন্যাসের ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন শওকত ওসমান, শওকত আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুন, ইমদাদুল হক মিলন। নাটকের ক্ষেত্রে মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সেলিম আল দীন, হুমায়ুন আহমেদসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নাট্যকারকে আমরা পেয়েছি। চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, নারায়ন ঘোষ মিতা, আমজাদ হোসেন, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেলসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে আমরা পেয়েছি। ছড়া, গল্প ও সমালোচনার ক্ষেত্রেও অনেকেই অবদান রেখেছেন। এভাবে বাংলাদেশের সাহিত্য ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে।
অচিন্ত্য চয়ন : এখন একটা ধারা শুরু হয়েছে যে, পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি রক্ষার জন্য হাতিয়ার হিসেবে পত্রিকা বের করছেন। লাভের কথা বিবেচনায় না এনে মিডিয়ার পেছনে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন। আপনার দৃষ্টিতে এই ব্যাপারটা কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক?
রতনতনু ঘোষ : বাংলাদেশে চলছে মিডিয়া প্রকাশের মহা উৎসব। এখন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তার তথ্য প্রবাহকে এবং মানুষের চেতনা জগৎকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল হয়ে উঠেছে প্রতি ঘরের অভ্যন্তরীণ বিশ্বদুয়ার। শুধু রাজধানী ঢাকা থেকেই প্রায় দু’শ দৈনিক পত্রিকা বের হয়। অনলাইন পত্রিকা রয়েছে দেড় শতাধিক। টিভি চ্যানেল অর্ধ শতকের উপরে। এছাড়া রয়েছে বিদেশী চ্যানেলের অবাধ সুযোগ। মিডিয়া বিস্তারের ও বিকাশের ফলে এখন চ্যানেলের জন্মদিন পালিত হয় সাড়ম্বরে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সেখানে অংশগ্রহণ করেন সরকারী ও বেসরকারী দলের নেতানেত্রী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার ব্যক্তিবর্গ। মিডিয়ার অবাধ বিকাশ সমাজের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিককেই প্রভাবিত করে। গণতন্ত্র বিকাশে, সামাজিক উন্নয়নকে তুলে ধরতে এবং সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মিডিয়া। মিডিয়ার দানবীয় ভূমিকা নেতিবাচক। দলীয় মিডিয়ার নির্দলীয় ভূমিকা ছাড়া জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না। আবার নির্দলীয় মিডিয়ার দলীয় ভূমিকা বিতর্কিত হয়ে পড়ে। পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি রক্ষার জন্য হাতিয়ার হিসেবে পত্রিকা ব্যবহার করছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে পত্রিকাগুলো যখন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হয়ে উঠে এবং জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটায় না তখনই দেখা দেয় বিতর্ক ও বিপত্তি। অসৎ সাংবাদিকতা, বিকৃত তথ্য পরিবেশন এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ ছাপার দায়ে পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের সম্পাদকের দ- হয়েছে এবং প্রকাশনা বন্ধ হয়েছে। সাংবাদিকের ও সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা ব্যবহার করে রাষ্ট্র ও সমাজকে অস্থিতিশীল করার হাতিয়ার করলে তাকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। লাভের কথা বিবেচনায় না এনে মিডিয়ার ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন মূলত বিশাল অংকের কালো টাকার মালিকগণ। সেগুলো তেমন টেকসই হয় না, জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না। সংবাদপত্রের নীতিমালা লঙ্ঘন করে তারা পার পাবে না। পাঠকের নিকট এসব সংবাদপত্র গ্রহণযোগ্য হয় না বলে দ্রুত লোকসানের দিকে ধাবিত হয় এবং সাংবাদিকদের ও সংবাদকর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে ব্যর্থ হয়।
অচিন্ত্য চয়ন : নব্বইয়ে তো সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর পতন হয়ে যায়। ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। পার্টিও ভেঙে যায়। অনেকেই মনে করতে থাকেন সমাজতান্ত্রিক দর্শনটাই ভুল ছিল। আপনার দৃষ্টিতে কী মনে হয়?
রতনতনু ঘোষ : সমাজতন্ত্র মানবমুক্তির একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। মতাদর্শের পতন ঘটে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা, ত্রুটি, দুর্নীতি, ভোগবিলাসিতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে। সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায় হলো সাম্যবাদ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়ও সমাজতন্ত্রের সহাবস্থান রয়েছে। সমাজতন্ত্র সাম্যের কথা বলে, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলে। যতদিন মানবসমাজে দুর্নীতি, শোষণ, বঞ্চনা, অসাম্য, বৈষম্য থাকবে ততদিন সমাজতন্ত্রের গুরুত্ব থাকবে। গবেষণা ও পাঠের টেক্সট হিসাবে সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান। পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে প্রায়শ বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ দেখা দেয়। এতেই বুঝা যায়, পুঁজিবাদ মুক্তি আনেনি। পুঁজিবাদের বৈশ্বিক বিস্তার ও দৌরাত্ম্য সাম্রাজ্যবাদমুখী গন্তব্যে ধাবমান। বিশ্বায়নের ধারায় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে তা বিনির্মিত হয়ে চলেছে। সংস্কার আর মুক্তবাজারের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে কল্যাণ রাষ্ট্র। বিশ্বায়নের গতিপথে পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ প্রমাণ করে সমাজতন্ত্র এবং তার চূড়ান্ত লক্ষ্য সাম্যবাদ ছাড়া মানবমুক্তি নেই।
অচিন্ত্য চয়ন : যে বাঙালিকে আমরা ভাববাদী বলি, বাঙালির সেই ভাববাদের ভেতরেও আপনি সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সূত্র খুঁজে পান কীভাবে ?
রতনতনু ঘোষ : চিন্তামাত্রই বহুমাত্রিক ভাবের উৎকর্ষমূলক সৃজন। ভাববাদের আলোকেই যুক্তিবিন্যস্ত মন-মানসিকতা নিয়ে বস্তুবাদি চিন্তাধারায় অগ্রসর হওয়া যায়। বাঙালির যুক্তিবাদী ভাববাদ আর মানবমুক্তির আলোকপ্রয়াস সৃষ্টি করেছিল অব্যাহত মনুষ্যত্ববোধের ভাবধারা। সবার উপরেই মানুষকে স্থান দিয়ে তারা মানুষকেন্দ্রিক জগৎকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং সাহিত্য ও দর্শনের সমৃদ্ধি সাধন করেছেন। সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য বাঙালির সমাজের স্বতঃস্ফুর্ত ভিত্তি। সামাজিক আত্মীয়তা রক্তগত আত্মীয়তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাঙালির সমাজে আছে পারস্পরিক সংবোধনের আত্মীয়গত পরিভাষা। এছাড়া বাঙালির সমাজ দর্শনে আছে মানব মাহাত্ম্য ও আত্মিক উৎকর্ষের ভাবধারা। ধর্মভিত্তিক মনুষ্যত্ববাদ আর সমাজভিত্তিক আত্মীয়তাবাদ বাঙালি সমাজকে সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যে উন্নীত করেছে।
অচিন্ত্য চয়ন : বর্তমান সময়ে সাহিত্যের রাজনীতি নিয়ে তরুণদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? সাহিত্যে সমালোচনা অতি জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে সমালোচনা সাহিত্যটা তেমন শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কেন এ দুর্বলতা ?
রতনতনু ঘোষ : বর্তমান সময়ে সাহিত্যের রাজনীতি নিয়ে তরুণদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় তারা আত্মবিভ্রান্ত বলে। হঠাৎ করে দ্রুত খ্যাতিবান হওয়ার প্রবণতা তাদেরকে বিভ্রান্তির আবর্তে ফেলে দেয়। বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় আত্মসচেতনতা এবং সাহিত্যের দলীয় কোন্দল থেকে নিজেকে মুক্ত ও সতর্ক রাখা। সাহিত্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি যেমন আছে তেমনি আছে এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি। সাহিত্যকর্মীরা সকলে সফল সাহিত্যিক নন। সাহিত্যের চাকুরীজীবীরা সাহিত্যের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছেন। এ অবস্থায় সাহিত্য সাধনার সামগ্রী না হয়ে বাণিজ্যিক পণ্য হয়ে উঠেছে। মানসম্পন্ন সাহিত্য সৃষ্টি করে সংস্কৃতির নতুন গতিপথ এবং চিরায়ত ঐতিহ্য। যারা নিজস্ব সাধনায় শীর্ষ পর্যায়ের সাহিত্যিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছেন তাদের জীবনীপাঠ, রচনাপাঠ করা দরকার আত্মনির্মাণপ্রয়াসী তরুণদের। আমাদের সমালোচনা সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। ইদানিং অর্ডারি সমালোচনা আর লেখকদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সমালোচনা বিস্তারের ফলে প্রকৃত সমালোচনা সাহিত্যের দীনতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত সমালোচকের থাকে অনেক অর্জিত গুণাবলী। কষ্টকর সমালোচনার কাজটি এখন আর কেউ করতে চায় না স্বেচ্ছায়। এজন্য স্বত:স্ফুর্ত সমালোচনা অপেক্ষা তোষামোদী সমালোচনাই অধিক প্রসারিত। নির্মোহ, সৎ ও আদর্শ সমালোচনা জাতির উন্নয়নের সহায়ক। সমালোচককে হতে হয় নির্ভীক ও বহুবিদ্যায় প-িত।
অচিন্ত্য চয়ন : সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ মুখদিয়ে শব্দ উচ্চারণ করতে না পারলেও ইশারা ভাষায় কথা বলতো। তখনকার ভাষা আর এখনকার ভাষার মধ্যে আপনি কি পার্থক্য লক্ষ্য করেন ?
রতনতনু ঘোষ : ভাষা মানুষের সৃজন। ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষার সৃষ্টি। ভাষা সকলের আছে। ভাববিনিময়ের নানা কৌশল রয়েছে বিভিন্ন সমাজে। ইশারা ভাষা থেকে বাক ভাষায় উন্নীত হওয়ার মধ্যে লক্ষ্যণীয় মানুষের সামাজিক সংগ্রাম এবং শ্রমের ভূমিকা। বাক ভাষার নান্দনিক রূপ আরো উৎকর্ষম-িত হয় লিপি বা অক্ষর আবিষ্কারের পরে। অক্ষরের ক্ষমতা মানে ভাষার ক্ষমতা। ভাষা সমস্ত কিছু প্রকাশের আশ্রয়। ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সব কিছুই ভাষার অন্তর্গত হয়ে ইতিহাসের সৃষ্টি করে। ভাষার যেমন ইতিহাস আছে তেমনি যাবতীয় সৃষ্টিরও আছে ইতিহাস। সকল ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য আশ্রয় লিখিত ভাষা। বর্তমানে বাকভাষা ক্যাসেট সংস্কৃতির মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। ভিডিওবদ্ধ দেহভাষা আর বাকভাষা মিলে মানুষের সামাজিক মঞ্চে অভিনয়ের রূপ ও স্বরূপ আরো আকর্ষণীয় রূপে তথ্যের হিমাগারে সংরক্ষিত হচ্ছে। মানুষের সামাজিক জীবনের ব্যবহারিক ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা আর জাতীয় জীবনের আদর্শ ভাষায় পার্থক্য আছে। পার্থক্য যাই থাক ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের আশ্রয় ও মাধ্যম।
অচিন্ত্য চয়ন : প্রতিটি শিল্প সৃষ্টির পিছনে শিল্পির কী অমরত্বের আকাক্সক্ষা বা পরম্পরায় বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকে ?
রতনতনু ঘোষ : প্রত্যেক শিল্পীর সত্তা অস্তিত্বশীল থাকেন তাঁর সৃষ্টিতে। শিল্প সৃষ্টির পিছনে থাকে শিল্পীর বেঁচে থাকার বাসনা। তবে শুধু বেঁচে থাকার জন্য শিল্পী সৃষ্টি করে না। তাঁর প্রতিভার বিকাশ এবং সামাজিক দায় পালনের মাধ্যম হলো তার সৃষ্টিকর্ম। জগতের বহুবর্ণিলতা ও সৌন্দর্য শিল্পীকে বিমোহিত করে। তিনি তার প্রকাশ ঘটান শিল্পে। সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা তাকে দ্রোহী করে। শিল্প হলো দ্রোহ প্রকাশের মাধ্যম। শিল্পী বর্তমানকে পেরিয়ে ভবিষ্যতের নির্মাতা। তিনি তার চিন্তাধারা ভবিষ্যতের জন্য নিবেদেন করেন বিবেচনার জন্য। সেসূত্রে অনেক সার্থক স্রষ্টা বেঁচে থাকেন তার চিরায়ত শিল্পলোক অবলম্বন করে।
অচিন্ত্য চয়ন : তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দশকের কবি হয়ে ওঠার একটা পলিটিক্স চলছে এটাকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন ?
রতনতনু ঘোষ: কবিদের দশকওয়ারী বিভাজন তাদের আবির্ভাবকালকে নির্দেশ করে। দশকওয়ারী বিভাজন কাল নির্দেশের মানদ-। কিন্তু এক দশকের আগেই অনেকের কবি হিসেবে নি:শেষ হয়ে যান। এটি বড় করুণার। দশক বিভাজনকে রাজনীতির উপকরণ করে দশকবন্দি কবিরাই। দশকউত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে মহাকালের কবি করতে পারলে দশকের বৃত্ত ভেদ করা যাবে। সেজন্য প্রয়োজন দশকের সম্রাট না হয়ে মহাকালের কল্লোলে নিজেকে ধাবমান রাখা। নিজস্ব মৌলিক সৃষ্টির ভূবন গড়তে অক্ষমেরা দশক ধরে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি প্রকাশ করে। এজন্য তারা সৃষ্টি করে কবিতার দশকভিত্তিক রাজনীতি। প্রত্যেক লেখকের জীবনের কালক্রমিক বিকাশ আছে। সেজন্য দশকের অধীনতায় থেকে নিজেকে দশককবলিত করার হীনপ্রয়াস গুরুত্বহীন বিষয়।