পৃষ্ঠাসমূহ

দেশে অনেকেই যোগ্য নেতা আছেন, কিন্তু জনগণের কাছে তাদের অধিকাংশই বিশ্বস্ত ও দেশপ্রেমিক নন

দেশে অনেকেই যোগ্য নেতা আছেন, কিন্তু জনগণের কাছে তাদের অধিকাংশই বিশ্বস্ত ও দেশপ্রেমিক নন— রতনতনু ঘোষ


[রতনতনু ঘোষ প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও সমাজচিন্তক। তিনি ত্রিশবছর ধরে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা সাত শতাধিক এবং প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৪৩টি। মানুষের স্বরূপ, স্বদেশ সমাজ সাহিত্য, রাজনীতিহীন রাজনীতি, মুক্তচিন্তা, বিশ্বায়নের রাজনীতি, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ—নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত প্রবন্ধ, উত্তরাধুনিকতা, বহুমাত্রিক বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র: স্বরূপ সংকট সম্ভাবনা, ৩৪ নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার। পেশাগত জীবনে অধ্যাপনা করছেন। একদিন বিভিন্ন বিষয়ে রতনতনু ঘোষ-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন শফিক হাসান।]




আপনি দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন। দৈনিক পত্রিকায় সমকালীন সমস্যা, বিশেষত রাজনীতি নিয়ে ইত্তেফাক, ভোরের কাগজ, যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন সাপ্তাহিকে লিখে চলেছেন। তাতে কি বাঙলাদেশের রাজনীতির কোনো গুণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
আমি সমকালীন সমস্যার উত্তাপ অনুভব করি। একজন সচেতন নাগরিক হিশেবে নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করি, রাজনীতির অবস্থা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করি। তাতে সাধারণ পাঠক অবহিত হন, সচেতনতা লাভ করেন। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ দৈনিক পত্রিকাগুলির কলাম পাঠ করেন কিনা জানি না। যদি পড়তেন তাহলে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ও প্রবণতা অন্যরকম হতো। দলীয় সিদ্ধান্তে চালিত হন রাজনীতিকরা। রাজনৈতিক দেশগুলিতে গণতন্ত্র অনুশীলনের অভাব আছে। বাইরের প্রভুশক্তির প্রেসক্রিপশনেও এসব দল চালিত হয়। জনগণের স্বার্থের কথা তারা মুখে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের কথা তাদের মুখসর্বস্ব। ফলে তাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা হতে বঞ্চিত হয়। মনে হয় না আমার লেখা রাজনীতি বিষয়ক কলাম ও প্রবন্ধ কোনো প্রভাব রেখেছে রাজনীতিতে। তবে রাজনৈতিক চিন্তাধারা তুলে ধরাই আমার কাজ। পাঠকের কাজ পাঠ করা।
স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে বাঙলাদেশে কাঙ্ক্ষিষত অগ্রগতি কতটুকু?
বিগত বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যে বাঙলাদেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একুশ বছর সেনা শাসনাধীন ছিল। সেনা শাসনাধীনে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকশিক হতে পারে না। সেনা শাসকেরা দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাঙলাদেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত অবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে এসেছে। উন্নয়নকামী থেকে উন্নয়নশীল হয়েছে। এখন ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন করে মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে প্রশংসা পেয়েছে বাঙলাদেশ। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র বাঙলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে। পোশাক শিল্পের অগ্রগতি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, খাদ্যে স্বয়ংসর্ম্পূণতা বাঙলাদেশকে বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত করেছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও দেশের অগ্রসরমান অবস্থা ইতিবাচক। এ দেশ ইতিপথে সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাইলফলক হতে পারে ২০০১, ২০৩০ ও ২০৫০ সালের রূপকল্প অনুযায়ী। বিশ্বায়নের এ যুগে বাঙলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ। সে জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি বর্জন করা।
বিশ্বায়নের প্রভাবে বাঙলাদেশ কতটুকু উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
বিশ্বায়নের মুক্ত প্রবাহের সুফল পেতে ভিসামুক্ত বিশ্বায়ন জরুরি এবং আমাদের উৎপাদিত পণ্য উন্নত দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। এগুলি হলে বাঙলাদেশ অধিক সুফল পেতো। তবে এদেশের সস্তা শ্রমিক ব্যবহার করে তৈরি পোশাক শিল্প এগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিভিন্ন দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্ববাণিজ্যের অগ্রগতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। ভারত, জাপান, হ্যানয়সহ শিল্পোন্নত দেশগুলির সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কে জোরদার করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং অর্থনীতিভিত্তিক রাজনীতি চালু হলে দেশ ও জনগণ বিশ্বায়নের সুফল পাবে। আমাদের দেশের বিরোধী দল অত্যন্ত দুর্বল পর্যায়ের। তারা ক্রমাগত সংসদ বর্জন করে, বর্ধিত বেতন-ভাতা নেয় অথচ জনগণকে বঞ্চিত করে। এদেশের রাজনৈতিক দলগুলি বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে নিজেদের গঠন ও বিকাশ করতে পারেনি। শিল্পায়নের ও বিশ্বায়নের প্রভাবেই কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাঙালিরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বাঙালির বিশ্বায়ন হয়েছে। বাঙালিরা বাঙলাদেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ করে সহযোগিতা করতে পারে। বাঙলা ভাষার বিশ্বায়ন ঘটেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় বাঙলাদেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
মিডিয়াগুলি কি জনগণের পক্ষে নাকি রাজনৈতিক দলের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে?
বাঙলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলি জনগণের চোখ ও বিবেক হিশেবে ভূমিকা পালন করার কথা। দলীয় মালিকানার মিডিয়াকেও নির্দলীয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। নইলে জনগণ সে চ্যানেল থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় অন্য চ্যানেলে, অন্য পত্রিকা পাঠ করে। জনগণের আকাক্সক্ষার কণ্ঠস্বর না হলে জনগণ মিডিয়াকে বর্জন করে। মিডিয়ার অনিরপেক্ষ ভূমিকা ও দানবীয় তৎপরতা এ দেশের জনগণ মেনে নেয় না। মিডিয়ার অবাধ স্বাধীনতার অপব্যবহার করলে জনগণ অসন্তুষ্ট হয়। দেশ ও সরকারের ইতিবাচক দিক তুলে ধরা প্রয়োজন গুরুত্বসহ। শুধু বিজ্ঞাপন নির্ভরতা ও সস্তা বিনোদনে মিডিয়ার মৃত্যু ঘটে জনচেতনায়। মিডিয়ার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তরুণ-যুবকদের জন্য ক্ষতিকর। মিডিয়ার কর্মীদের আরো উদ্ভাবনামূলক কাজে অগ্রসর হতে হবে। কারণ বর্তমানে বেশ প্রতিযোগিতা চলছে মিডিয়াগুলির মধ্যে। টিকে থাকার দায় নিয়েই তাদের বিকশিত হতে হবে।
সংস্কৃতির বিকাশে তরুণ সমাজকে কীভাবে অংশীদার করা যায়?
বর্তমানে একদিকে মিডিয়াসংস্কৃতি অন্যদিকে প্রাত্যহিক জীবনসংস্কৃতির প্রবাহ চলছে। তরুণ সমাজ তথ্য ও প্রযুক্তিভিত্তিক সংস্কৃতির বিকাশে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তরুণ-যুবকদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এটা ইতিবাচক। কিন্তু সাইবার ক্রাইমে জড়িয়ে কলঙ্কিত হওয়া ও আসক্ত হওয়া খারাপ। এ থেকে সুরক্ষা হতে পারে সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থা ও সাইবার আইন প্রয়োগ করে। সংস্কৃতিকে পণ্য করে মিডিয়াগুলি টিকে থাকতে চায়। তাতে মানবিক সংস্কৃতি ও জীবনসংস্কৃতির প্রাধান্য থাকা দরকার। আমাদের তরুণ খেলোয়াড়রা বিশ্ব ক্রিকেট বিজয়ী হয়েছে, হিমালয়-এভারেস্ট বিজয়ী হয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। সভ্যতা নির্মাণে সংস্কৃতির ভূমিকা আছে। তারুণ্যশক্তিকে অপরাজনীতির কাঁচামালরূপে ব্যবহার না করে ইতিবাচক খাতে ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই তরুণদের নিয়ে আশা-ভরসার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
লিটল ম্যাগাজিনগুলি সাহিত্য বিকাশে কী গুরুত্ব বহন করে?
লিটল ম্যাগাজিনগুলি সাহিত্যের পরীক্ষালয়। নতুনদের চিন্তার আশ্রয়দাতা। নতুন ও ব্যতিক্রমী কিছু ধারণে ও প্রকাশে অগ্রণী লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিন অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপননির্ভর হলে সে ধরনের সুযোগ কমে যায়। নতুন ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যপ্রয়াসীদের সন্ধান করা যেতে পারে লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। হবু, নতুন ও অখ্যাতদের আশ্রয় দিলে তারা উৎসাহী হয়ে লিটল ম্যাগাজিনের আশ্রয়ে আত্মবিকশিত হতে পারে। ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে তরুণ-নবীন লেখকদের আত্মপাঠ সম্ভব হয়। এদেশে বর্তমানে বিশেষ সংখ্যাভিত্তিক বর্ধিত কলেবরের ম্যাগাজিন হয়। এগুলি ভালো। তবে প্রায়শ সেগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ভুলে ভরা ম্যাগাজিনগুলি তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। লিটল ম্যাগাজিনের বৃহৎ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নির্ভর করে ভালো লেখা ও ভালো সম্পাদনাকর্মের ওপর।
আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি খুব একটা নেই। আপনি কি তাই মনে করেন?
সংখ্যায় কম হলেও আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি আছে বেশ ভালোভাবেই। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, ওরা এগারোজন, গেরিলা তো মুক্তিযুদ্ধের নামকরা চলচ্চিত্র। এছাড়া মাটির ময়না, শ্যামল ছায়া, আগুণের পরশমণি উল্লেখযোগ্য। আরো অনেক চলচ্চিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ। তবে মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ ক্যানভাসে আরো সফল ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র রূপায়িত হতে পারে। তাহলে জাতিসত্তার মহান সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি কাক্সিক্ষত ও পরিকল্পিত রূপ পেতে পারে।
বিদ্যুৎ ঘাটতি আর মহানগরের যানজট নষ্ট করছে শ্রমঘণ্টা, বেশি কাজ করার সুযোগ। এ থেকে মুক্তির উপায় কী হতে পারে?
বর্তমানে মানুষ হয়ে উঠেছে সাইবার সিটিজেন, সাইবর্গ (অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক যন্ত্র) ও বৈদ্যুতিক সংস্কৃতিনির্ভর জীবনের অধিকারী। বর্তমান সভ্যতা হলো ইলেকট্রিক্যাল ও বিদ্যুৎনির্ভর। মানুষের গতিশীলতা ও ছুটোছুটি বেড়েছে। মহানগরের মানুষগুলি সারাদিন ঘরে থাকে না, তারা কর্মব্যস্ত জীবনে মধ্যরাত পর্যন্ত বাইরে থাকেন। সরকার চেষ্টা করছে ফ্লাইওভার, উড়ালসেতু, সড়কপথ সংস্কার ও প্রশস্ত করে এবং রেলপথ বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করতে। মেট্রোরেল ও নৌপথ সমাধানের আরো বিশেষ পথ। প্রতিদিন প্রায় আড়াই শতাধিক নতুন গাড়ি নামে। ঢাকা মহানগরীকে যত যানজটমুক্ত করা হবে গ্রামের লোক এখানে তত বাড়বে। এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন পাবলিক গাড়ির সার্ভিস বৃদ্ধি করা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, কাজের প্রয়োজনে ঢাকায় মানুষকে আসতে বাধ্য না করা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা শহর আরো ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। মহানগরগুলির সুযোগ-সুবিধা প্রান্তিকের দিকে স্থানান্তরিত করতে হবে। বিদ্যুতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়া আমাদের উন্নয়নের স্বপ্ন ও ডিজিটাল বাঙলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূর্ণ হবে না। সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার ও সহজলভ্যকরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বপুঁজিবাদীরা এখন এশিয়ার দিকে নজর দিচ্ছে কেন?
বৈশ্বিক প্রভুশক্তি তাদের সা¤্রাজ্য বিস্তার করছে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিতে। সেখানে তাদের বাণিজ্য বিস্তার, শ্রমশোষণ আর রাজনৈতিক আধিপত্য চলে অবাধে। দ্বিমেরু বিশ্ব আজ বিশ্বায়নকালে বহু মেরুবিশিষ্ট হয়েছে। এককেন্দ্রিক বিশ্ব আজ জি-২০ভুক্ত দেশগুলি নিয়ে বিশ্ববাণিজ্য ও বিশ্ববাজার বিস্তার করতে চাচ্ছে। ব্যবসাবাণিজ্য ও ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা হিশেবে শুধু এশিয়ার মহাদেশেই আছে শতকরা ষাট ভাগ লোক। এ ছাড়া চীন ও ভারত পরাশক্তি হিশেবে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ভারতে আছে দেড়শত কোটি মানুষ, চীনে আছে প্রায় পৌনে দুইশত কোটি মানুষ। জাপানসহ এশিয়ার বেশকিছু দেশও শিল্পোন্নত ও অগ্রসর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এশিয়ায় ঢুকে প্রভাবশালী হতে চায়। তাদের অনুগত সরকারগুলিকে বিশ্বপুঁজির স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ এশিয়া গঠনের জন্য তারা বিনিয়োগ করতে চায়। সস্তা শ্রমশক্তি, বিশাল জনসম্পদ, প্রাকৃতিক ও সমুদ্রসম্পদ এবং পণ্যের বৃহৎ বাজার সন্ধানে ইউরোপ-আমেরিকা আজ এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এশিয়ার সম্ভাবনা তারা অতীতে বুঝেছিলো। পুনরায় বুঝেছে এশিয়ার জনশক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে। এ জন্য বিশ্ব পুঁজিবাদীরা ঐক্যবদ্ধ ও বৃহৎ এশিয়ার দিকে ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে।
ভবিষ্যতের বাঙলাদেশ কেমন হতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হলে দেখতে হবে অতীতে বাঙলাদেশ কেমন ছিলো। বাঙলাদেশের আছে প্রায় বারোশত বছরের ইতিহাস। অতীতে বাঙলাদেশকে বলা হতো বঙ্গ, রাঢ়, সমতট, গৌঢ়, পুন্ড্র, হরিকেল, সুহ্ম। আমরা ভারতবর্ষের অধীনে ছিলাম, পরে ১৭৫৭ থেকে প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশের অধীনে ছিলাম। আমরা বৃহৎ ও যুক্ত বঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি ১৯০৫ সালে। আবার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ছিলাম। ভাষার আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে ১৯৭১ সনে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র পেলাম। বাঙালিরা বারবার শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে বিদেশি, বিজাতি ও বিভাষীদের মাধ্যমে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব সংবিধান আমরা পেয়েছি। বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার অবস্থান অর্জিত হয়েছে। এ স্বাধীনতা নিয়েও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হয়েছে প্রচুর। জাতির জনক হত্যাসহ স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষদের ষড়যন্ত্র আজও অব্যাহত আছে। এসব রুখে দিয়ে বর্তমানকে নিরাপদ আর ভবিষ্যতকে নির্মাণ করতে সচেষ্ট থাকতে হবে সকল শুভশক্তি ও দেশপ্রেমিক জনতাকে। প্রগতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার। পশ্চাৎপন্থী রাজনীতি আমাদের অগ্রগতির বাধা। বিগত চার দশকে বাঙলাদেশের অর্জন অনেক। অগ্রসর বাঙলাদেশকে পাঠ করতে হবে। যাবতীয় নেতিবাচক অবস্থা-পরিস্থিতি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। বাঙলাদেশি বাঙালি আজ বিশ্ববাঙালি হয়েছে। আমাদের বিশ্বমুখশ্রী হলেন লালন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য, ইউনূস, মুজিবসহ অনেকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের স্বপ্ন ছিলো বাঙলাদেশ নিয়ে। তারা নিরাপদ, স্বনির্ভর, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। আমিও সেই স্বপ্ন দেখি। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাঙলা’র প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চৈনিক ও ইউরোপীয় পর্যটকেরা। সুকান্তের ‘সাবাশ বাঙলাদেশ’ বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে ভাষা আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলি অশিক্ষা, দারিদ্র্য, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে নিজেদের মধ্যে আত্মধ্বংসী লড়াই নিয়ে ব্যস্ত। গণতন্ত্র নির্মাণে তারা জাতীয় ঐকমত্য করতে ব্যর্থ। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাঙলা, নজরুলের জয়বাঙলা আর শেখ মুজিবের বাঙলাদেশ পেয়েও এবং সংগ্রামী ও স্বপ্নবান জাগ্রত জনতা পেয়েও রাজনৈতিক দলগুলি উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাঙালি জাতিসত্তার স্বকীয় আদর্শ আছে, চিন্তাবিদদের উন্নয়নসূত্র আছে। নেই সেগুলি গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হওয়ার রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উপযুক্ত নেতৃত্ব।
নিকট অতীতে বাঙলাদেশের গায়ে ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের তকমা লাগাতে চেয়েছেন এদেশেরই কিছু মানুষ। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
বাঙলাদেশকে শুধু নয় পৃথিবীর বহু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকেই ব্যর্থ ও অকার্যকর বলে গণ্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতির শীর্ষস্থানে অবস্থান, সন্ত্রাসনির্ভর ও সহিংস রাজনীতির কারণে বাঙলাদেশকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিলো। ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের তালিকা যারা তৈরি করেছেন তারা কতগুলি সূচকের ভিত্তিতে তারা করেছেন। অতীতে বিশেষত সন্ত্রাসের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি, জঙ্গিবাদ, গ্রেনেড হামলা ও খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। এছাড়া দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণহীনতা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে দেয়। এজন্য জনগণ অথবা রাষ্ট্রকে দায়ী করা চলে না। রাষ্ট্র কখনো ব্যর্থ বা অকার্যকর হয় না। আসলে সুশাসনে ব্যর্থ এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ সরকারই রাষ্ট্রকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে। জনগণ সে জন্য দায়ী নয়। সরকারকে প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে পারে জনগণ। বর্তমানে বাঙলাদেশ কালো তালিকাভুক্তি কাটিয়ে উঠেছে, ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়েছে। তবে সরকার ও বিরোধী দলকে আরো উদ্যোগী হয়ে জনগণ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সচেষ্ট হতে হবে। ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়, বরং উন্নয়নের রোল মডেল ও এশিয়ার টাইগার হয়ে উঠছে বাঙলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, সুইডেন, ব্রিটেন, সৌদি আরবসহ বহু দেশ আজ বাঙলাদেশের প্রশংসা করছে। অমর্ত্য সেন, ক্যামকেল লামি, হিলারি ক্লিনটন, বারাক ওবামা, মুহম্মদ ইউনূসসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাঙলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। বাঙলাদেশ ২০২১ সালের, ২০৩০ সালের এবং ২০৫০ সালের রূপকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কোনোরূপ বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটলে বাঙলাদেশ অবশ্যই মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র হবে এবং উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিজেকে উন্নীত করবে। ইতোমধ্যে বিদেশিরা বাঙলাদেশকে উদীয়মান ব্যাঘ্র, পূর্ববর্তী চায়না বলেও গণ্য করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে দেশ চরম সংঘাতের দিকে এগুচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার চিন্তা কী রূপ?
তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছিলো নির্বাচনকালীন সরকার হিশেবে। অতীতে বিএনপি সরকার আমলে বিতর্কিত সিইসি এবং বিতর্কিত লোককে প্রধান উপদেষ্টা করার ষড়যন্ত্র হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিলো। বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিমুখ ছিলেন। বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি মৃত। কারণ হাইকোর্টের রায়ে সংসদ তা বাতিল করেছে। বিরোধী দল সংসদে গিয়ে তা রক্ষা করার চেষ্টা না করে এ ইস্যু নিয়ে রাজপথে গিয়ে চরম পন্থার আন্দোলন করায় জনগণ তাতে সমর্থন ও সাড়া দেয়নি। একের পর এক আন্দোলন করে ভাংচুর করার আইনিভাবে বিরোধীদলকে মোকাবেলা করছে সরকার। শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ সর্বদলীয় হতে পারে। নির্দলীয় অপেক্ষা সর্বদলীয় ও বহুদলীয় সরকার ভালো। তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প প্রস্তাব বুদ্ধিজীবীরা পেশ করেছেন। বিরোধীদল এককেন্দ্রিক চিন্তা করে অনুদার ও মূল্যহীন রাজনীতির পরিচয় দিচ্ছে। তারা বিকল্প চিন্তা নিয়ে ইতিবাচকভাবে এগুলে জনগণ খুশি হবে এবং দেশ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে।
তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা কি এড়ানো যায়? তৃতীয় শক্তির উত্থানের জন্য আরেকটি ওয়ান ইলেভেন কি সৃষ্টি হতে পারে?
তৃতীয় শক্তি উত্থিত হয় রাজনৈতিক দলগুলির ব্যর্থতা, অসহযোগিতা ও অদূরদর্শিতার জন্য। গণতান্ত্রিক শক্তি, অরাজনৈতিক শক্তি কখনো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিকল্প হতে পারে না। তা প্রমাণিত হয়েছে অতীতে। সংসদ বর্জন করে, সংলাপ ও সমঝোতার পথ এড়িয়ে গণতন্ত্রকে দুর্বল করা যায়। এমনকি সংঘাতময় রাজনীতি ও পরস্পরবিনাশী তৎপরতার মাধ্যমে তৃতীয় শক্তিকে আহ্বানও করা যায়। ৪২ বছরের বাঙলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২১ বছর সেনাশাসন ছিলো। সামরিক বাহিনীর লোকেরা এখন বিশ্বশান্তি রক্ষায় ব্যস্ত। তারা দেশের সুনাম বৃদ্ধি করছে। এ মুহূর্তে তারা সরাসরি ক্ষমতায় আসতে চান না। বদনাম কামাতে চান না। খুচরা রাজনৈতিক দলগুলির গণভিত্তি নেই। অনির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলি বড় দলের লেজুড়বৃত্তি করে। তারা জোটবদ্ধ রাজনীতির অংশীদার। ড. কামাল হোসেন, ডা. বি চৌধুরী, ব্যারিস্টার রফিকুল হক তৃতীয় শক্তি রূপে আবির্ভূত হতে চান। কিন্তু জনগণ তাদের সমর্থনে অগ্রসর হয় না। সংস্কারবাদী বলে পরিচিতির প্রায়শ উৎসাহী হয় নিজেদের তৃতীয় শক্তিরূপে আত্মপরিচয় দিয়ে। আসলে তৃতীয় শক্তির রহস্যময় আবির্ভাব নিয়ে বিশ্বরাজনীতির প্রভুশক্তিই ভালো বলতে পারবেন। কারণ তারা সরকারি ও বেসরকারি রাজনীতিকদের চালিত করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে তারা নিয়মিত বৈঠক, আলোচনা করেন। অথচ সংসদে গিয়ে রাজনৈতিক সমাধান খোঁজেন না। নির্বাচিত সংসদ অপেক্ষা হাইব্রিড নেতা আর ফরমালিন রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেন। তৃতীয় শক্তি নিজ পরিচয়ে জনগণের নিকট প্রকাশ্য রূপ নিতে ভয় পায়। তৃতীয় শক্তি হলো অন্ধকারের শক্তি, অনিয়মতান্ত্রিক শক্তি, অগতান্ত্রিক শক্তি ও অরাজনৈতিক শক্তি। ওয়ান ইলেভেন একবারই আসে। দ্বিতীয়বার আসে না। এলেও ভিন্ন রূপে, নতুন আঙ্গিকে আসে। ওয়ান ইলেভেন হওয়ার পরিস্থিতি জোর করে করা যায়ও না। কারণ এ ব্যাপারে জনগণ ও সরকার বেশ সজাগ।
বাঙলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির শীর্ষ নেতৃত্বের যোগ্যতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
রাজনৈতিক দলগুলির শীর্ষনেতারা দীর্ঘদিন ধরে গণসম্পৃক্ত থেকে, কাজের মাধ্যমে গণসমর্থন লাভ করে নেতা হন। যেমনটি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক। গণস্বার্থে জেল-জুলুম তুচ্ছ করেন গণনেতা। বাঙলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মতো দ্বিতীয় নেতৃত্ব নেই। তার অনুসারীরাও চেষ্টা করেছেন নেতা হতে। অনেকেরই উজ্জ্বল রাজনৈতিক পটভূমি আছে। ত্যাগ-তিতীক্ষা আছে তাদের। নেতৃত্বের গুণাবলি ও যোগ্যতা অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মান অনুযায়ী নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। আবার নেতৃত্বের তৎপরতা অনুযায়ী জনগণ অগ্রসর হন। বাঙলাদেশে অনেকেই যোগ্য নেতা আছেন, কিন্তু জনগণের কাছে তাদের অধিকাংশিই বিশ্বস্ত ও দেশপ্রেমিক নন। দুর্নীতিমুক্ত, সৎ আদর্শনিষ্ঠ ও ত্যাগী নেতৃত্বের বড় অভাব আছে। নতুনদের নিয়ে সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না রাজনৈতিক দলের। অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অনুশীলন না হওয়ায়। নতুনদের মধ্য থেকেও অনেকে জাগবে, নেতা হয়ে জনগণকে জাগাবে। পরিবেশ পরিস্থিতিও নেতৃত্ব তৈরি করে দেয়। নেতা যায়, নেতা আসে এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু জনগণ চিরকালীন ও অনিঃশেষ।

বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। আসলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে কীনা তা নিয়েও আছে সংশয়। আপনি কী ভাবছেন?
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো যুদ্ধাপরাধের বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। ১৪ জনের বিচারও সমাপ্তির পথে। পলাতক মওলানা আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায় হয়েছে। ন্যুরেনবার্গ ট্রাইব্যুনালের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য বাঙলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার ও রায়। যুদ্ধাপরাধীদের অধিকার ও আবেদন এতে রক্ষিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাদের বিচার কোনো দলীয় বা ব্যক্তিগত ইস্যু নয়। এটি জাতীয় ইস্যু। এটি প্রতিহিংসা বা আক্রোশ নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্ব বা বানচাল করতে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র চলেছে। ডিজিটাল তৎপরতা চলেছে। কিন্তু সরকার এ বিচার করতে বদ্ধপরিকর। দেশের মানুষ আশাবাদী। আমরাও এ ব্যাপারে আশাবাদী।
বাঙলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রায়শ বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ঘটে। এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
বাঙলাদেশের রাজনীতিবিদরা বিদেশি প্রভুশক্তির মাধ্যমে চালিত হতে উৎসাহী। তারা নিজেদের দেশের রাজনীতির সমস্যা নিজেরা সমাধান না করে বিদেশি প্রভুশক্তির নিকট ধর্না দেন। রাশিয়া, ওয়াশিংটন, দিল্লি গিয়ে নিজেদের গোপন কথা বলে আসেন পরাশক্তির নিকট। এ জন্য বিদেশি প্রভুশক্তি রাজনৈতিক সংকটের সমাধান দেয়। দেশের রাজনীতিকে চালিত করার জন্য অবশ্য তারা বেশ ভালো কথা বলেন। মেরুদ-হীন রাজনীতিবিদরা তা বুঝেও বোঝেন না। কারণ পরনির্ভর রাজনীতিবিদরা চিন্তাগত দিক থেকেও পরনির্ভর। চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা আত্মচালিত হতে পছন্দ করেন। অথচ জনগণ চায় দেশি রাজনীতিকদের আলাপ-আলোচনা ও চিন্তাপ্রসূত সমাধান বেরিয়ে আসুক। যেমন— জনগণ হরতাল চায় না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও হরতালকে ঘৃণা করেন। অথচ রাজনীতিতে হরতাল নিষিদ্ধ হয়নি কিংবা হরতালের কাক্সিক্ষত বিকল্প গড়ে তোলেননি রাজনীতিকরা। যেমন জনগণ মাঠে ময়দানে সহিংস রাজনীতির চেয়ে সংসদে গিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চান। বিদেশি রাষ্ট্রদূতসহ প্রভাবশালীরাও তাই চায়। কিন্তু গণবিমুখ রাজনীতিবিদ বর্ধিত বেতনভাতা গ্রহণ করে লাগাতার সংসদ বর্জন করেন। এ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হলেই অকাম্য বিদেশি হস্তক্ষেপ কমে যাবে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিংস ও সংঘাতময় রাজনীতি নিয়ে শঙ্কিত থাকে। ফলে তারাও চায় জঙ্গিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত ও অন্যায়মুক্ত রাজনীতি দূর হোক। জনগণের চিন্তার চেয়েও পশ্চাৎপদ হলো এ দেশের রাজনীতিবিদের চিন্তা। কারণ— গণস্বার্থ অপেক্ষা দলীয় সুনীতি ও নেতাদের দলগত স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পায়।
কলামিস্টরা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন সিদ্ধান্ত প্রকাশে। লেখার ক্ষেত্রে অনিরপেক্ষ হওয়াই কি উচিত নয়?
কলামিস্টরা লেখার মাধ্যমে রাজনীতি করেন। তারা দলীয় মুখপাত্র ও ভাষ্যকার হয়ে উঠলে নিরপেক্ষ না থেকে পক্ষপাতদুষ্ট হন। তবে সত্য, ন্যায় ও ঔচিত্যের পক্ষে না থাকলে পাঠকরা সেই লেখা গুরুত্ব দেন না। কলাম বা লেখা হবে লেখকের অন্তর্গত চিন্তার দ্যুতি, কোনো দলের স্তুতি নয়। রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী লেখকরাই দলীয় লেখক, দলপালিত বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন। তাদের উদ্দেশ্যমূলক চিন্তাভাবনা জনগণের কোনো উপকারে আসে না। দলের সেবক না হয়ে গণসেবক হতে হলে লেখককে গণপ্রেমী, আদর্শবাদী ও চিন্তাশীল হতে হয়। তাহলে বিলম্ব হলেও তার মূল্যায়ন হয় চিন্তাবিদ হিশেবে। উদ্দেশ্যমূলক লিখনের মাধ্যমে সামাজিক সুবিধা বা পুরস্কার অর্জন করা যায়। তাতে দলীয় নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। আদর্শ কলামিস্টরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, গণআকাক্সক্ষার পক্ষে এবং ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। আমিও তেমনি চেষ্টা করি। দলীয় সত্য, ন্যায় ও আদর্শ প্রকাশের প্রচারমাধ্যম কমই মেলে। দলীয় প্রচারমাধ্যমে দলীয় বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টের ডাক পড়ে। নিরপেক্ষ চিন্তা তারা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে না। মুক্ত মতের বুদ্ধিজীবীদের চ্যানেলে টকশো করতে দেখা যায় না। দলীয় পত্রিকায় কলাম লিখতে দেখা যায় না। বুদ্ধিজীবী ও লেখকেরা রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে গেলে জনগণের জন্য স্বাধীন চিন্তার লোকের অভাব ঘটে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে লেখকের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সুযোগ তৈরি করে।